রাকিব হোসেন, স্টাফ রিপোর্টার :
প্রতি বছর ৮ মার্চ নারীদের সম্মান জানাতে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে, নারীর সমানাধিকারের জন্য পালন করা হয় নারী দিবস।
বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয়। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা প্রকাশ ও তাদের কাজের প্রশংসা করেই দিনটি পালিত হয়।
বাঙালি নারীর অধিকার আর মানবাধিকার পৃথিবীর অন্য সব নারী থেকে আলাদা নয়। তার পরও আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক ও
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হলে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের নারীদের সামগ্রিক সংকটের নাম নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনা হলেও এগুলোর ফলিত প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশভেদে ভিন্নতা দেখা যায়।
নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়টি এখন সবদেশে বিবেচনা করা হচ্ছে। নারী যেদিন থেকে তার অর্থনীতির চাবিটাকে পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে তার শৃঙ্খল ভোগের ইতিহাস।
নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এসেছে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের নারীদের চার ভাগে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। (১) উচ্চবিত্ত, (২) মধ্যবিত্ত, (৩ নিম্নমধ্যবিত্ত, (৪) নিম্নবিত্ত।
উপরোক্ত শ্রেণিবিভাগ থাকলেও সব শ্রেণির নারীদের শোষণের প্রক্রিয়া কিন্তু অভিন্ন। আজকে শ্রেণি, সমাজ, গ্রাম-শহর-নির্বিশেষে নারীর প্রতি অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা, ধরন আর তীব্রতা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের তীব্রতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, নারীর নিজের ঘরই হয়ে উঠেছে তার জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ স্থান। আত্মীয়তা, প্রেম, বিবাহ কোনো কিছু দিয়েই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবাজার অর্থনীতির অনিয়ন্ত্রিত প্রসার, সম্পদের বিতরণে বৈষম্য সব কিছু নারীকেই আঘাত করে সর্বপ্রথম। তাই নারী হয়ে ওঠে সামাজিক সহিংসতার সর্বপ্রথম টার্গেট।
বাংলাদেশের নারীরা কোনো সময়ই মসৃণপথ অতিক্রম করেনি। আজকাল বাংলাদেশের নারীদের জীবনে শুরু হয়েছে আরেক পারিবারিক দুর্যোগ বা অভিশাপ।
বিয়ে শুভ না হওয়া, স্বামীর হাতে নিগৃহীত হওয়া, গালিগালাজ, অপমান, যত রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যায় তা বাঙালি নারীরা অনেক আগে থেকেই ভোগ করে আসছে।
অপমানিত, আর নির্যাতিত হতে প্রায় অভ্যস্ত নারীরা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায় এক জীবনের কান্না শুধু সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য। সন্তানরা পরিবারের আবহে বড় হবে। নারী তো আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী নয়।
তাই সংসার ধরে রাখার দায়িত্ব তো তারই, যতই অত্যাচার আর অবহেলা হোক না কেন। তা ছাড়া এই সমাজ আর রাষ্ট্র পুরুষের মতো তাকে স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে চারখানা বিবাহ করার স্বাধীনতা দেয়নি। তাই তাকে সবই সহ্য করতে হবে।
এখন যোগ হয়েছে স্বামীদের অবাধ পরকীয়া। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে পরকীয়া সম্পর্ক এক মহামারির রূপ ধারণ করেছে। এই সমাজের মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী,
প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাদের পুত্ররাসহ সাধারণ পুরুষ- সবাই পরকীয়ায় মেতে উঠেছে। শুরু হয়েছে বাংলাদেশের মাঝবয়সী অর্থাৎ চল্লিশ-উত্তীর্ণ মহিলাদের জীবনে পারিবারিক সংকট।
আর এই সংকট যে আগে ছিল না তা নয়, তবে আজকের এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে এই পরকীয়ার প্রক্রিয়াটাও অনেক সহজসাধ্য হয়েছে। অনেকেই বলবেন, এই প্রক্রিয়ায় তো মেয়েরাও জড়িত।
নারীর ক্ষতি বা সর্বনাশের জন্য নারীরাই দায়ী। তা কিন্তু নয়, এখানেও বিষয়টা অর্থনৈতিক সমস্যার অন্তর্ভুক্ত। নারীর অর্থনৈতিক সংকটের আবর্তের সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে আজকের পৃথিবী। আধুনিক বিশ্বে নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে একইসঙ্গে সব স্তরে কাজ করছে।
তবে নারীর ন্যায্য অধিকার নিয়ে কর্মস্থলে সফলভাবে কাজ করতে পারার পেছনে রয়েছে এক সাহসী সংগ্রামের ইতিহাস।১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সুতা কারখানার নারী
শ্রমিকরা তাদের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে আট ঘণ্টায় কমিয়ে আনার দাবিতে ও বৈষম্যহীন ন্যায্য মজুরি আদায়ের তাগিদে পথে নামেন।তাদের এ আন্দোলনে আটক হন অনেক নারী শ্রমিক।
পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে বস্ত্র শিল্পের নারী শ্রমিকরা কাজের সুস্থ পরিবেশ, সময় ও যোগ্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন।
জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সেবছর সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নারীদের সম্মানে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক দল পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৯ সালে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ জাতীয়ভাবে নারী দিবস পালন করে।
এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এতে অংশ নেয় ১৭টি দেশ থেকে আসা ১শ জন নারী প্রতিনিধি। এতে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ০৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন।
সম্মেলনে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯১১ সাল থেকে ০৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করা হয়।
এ ঘোষণা আলোড়ন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে। ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ প্রথমবারের মতো অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মান ও সুইজারল্যান্ডের এক মিলিয়নেরও বেশি নারী যোগদান করে নারী
দিবসের রেলিতে। একই সঙ্গে এগিয়ে আসে পুরুষরাও। তারা নারীদের ভোটদান ও সরকারি অফিসে কাজ করার অধিকার আদায়ের দাবি জানান।ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে থাকে নারী অধিকার বিষয়ক সচেতনতা।
১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে রাশিয়া ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার পালন করে আন্তির্জাতিক নারী দিবস। ১৯১৪ সালের ০৮ মার্চ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার দাবিতে ইউরোপে নারীরা Raly বের করেন। সেবছর বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেই দিনটি পালন করা হয়।
এদিকে, ১৯৭১ সালে ০৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম পালিত হয় নারী দিবস। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তজার্তিক স্বীকৃতি পায় নারী দিবস। সেই থেকে ০৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিশ্বের সব নারীর জন্য রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা।
লেখক- মোঃ আবেদ আহমেদ