কাঞ্চনজঙ্ঘা সৃষ্টির এক অপরূপ সৌন্দর্য
জানা-অজানা :কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এটি নেপাল ও ভারতের সীমানায়, পূর্ব হিমালয়ের একটি মহিমান্বিত শৃঙ্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৮,৫৮৬ মিটার (২৮,১৬৯ ফুট)। এভারেস্ট ও কে-টু-এর পর এটি পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত। কাঞ্চনজঙ্ঘা নামটি এসেছে তিব্বতি শব্দ থেকে—‘কাঞ্চন’ অর্থ সোনা আর ‘জঙ্ঘা’ অর্থ পাঁচটি ধনভাণ্ডার। অর্থাৎ “বরফে ঢাকা পাঁচটি ধনভাণ্ডার”। পাঁচটি শৃঙ্গকে পাঁচ ধনভাণ্ডার হিসেবে ধরা হয়, যেখানে বলা হয় দেবতাদের আশীর্বাদে অমূল্য সম্পদ লুকানো রয়েছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা মূলত পাঁচটি প্রধান শৃঙ্গ নিয়ে গঠিত—মূল কাঞ্চনজঙ্ঘা, সাউথ, সেন্ট্রাল, ওয়েস্ট এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা-ইয়ালুং। এই পর্বত নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় তাপলেজুঙ জেলায় এবং ভারতের সিকিম রাজ্যের উত্তর সীমান্তে বিস্তৃত। হিমালয়ের এই অংশকে বলা হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমাল। এটি কেবলমাত্র উচ্চতার জন্য নয়, বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হিমবাহ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্যও বিখ্যাত। কাঞ্চনজঙ্ঘা অঞ্চলে ইয়ালুং ও জংসং হিমবাহসহ আরও বেশ কয়েকটি বরফনদী প্রবাহিত হয়েছে, যা থেকে তিস্তা ও তামোর নদীর উৎপত্তি।
স্থানীয় মানুষের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু একটি পর্বত নয়, বরং পবিত্র দেবস্থান। সিকিম ও দার্জিলিং অঞ্চলের লেপচা সম্প্রদায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে তাঁদের রক্ষাকর্তা দেবতা হিসেবে মানেন। প্রতি বছর বিশেষ উৎসব ও পূজা হয় এই পর্বতকে কেন্দ্র করে। নেপাল ও ভুটানের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছেও এটি অতি সম্মানিত। অনেক কিংবদন্তিতে বলা হয়, এই শৃঙ্গগুলিতে দেবতার ধনভাণ্ডার আছে—শস্যভাণ্ডার, লবণের ভাণ্ডার, রত্নভাণ্ডার, অস্ত্রভাণ্ডার ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।
কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রথমবার ১৮৪৮ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ডগলাস উইলিয়াম ফ্রেশফিল্ডের দ্বারা জরিপ করা হয়। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন কেউ এটিকে জয় করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৫৫ সালের ২৫ মে ব্রিটিশ অভিযাত্রী জর্জ ব্যান্ড ও জো ব্রাউন প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে পৌঁছান। তবে তাঁরা স্থানীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শৃঙ্গের একেবারে চূড়ায় না উঠে কয়েক ফুট নিচে থেমে যান। পরবর্তীতে সকল অভিযাত্রীই সেই প্রথা অনুসরণ করেছেন। আজও কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করা খুবই কঠিন ও বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। অতি উচ্চতা, তুষারধস, আকস্মিক ঝড় এবং হিমবাহের ফাটল এর প্রধান ঝুঁকি।
কাঞ্চনজঙ্ঘা অঞ্চলে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক, যা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত। এখানে তুষারচিত্তল, লাল পান্ডা, হিমালয়ান ভাল্লুকসহ অনেক বিরল প্রাণী পাওয়া যায়। চারপাশে প্রাকৃতিক বনভূমি, অর্কিড, রডোডেনড্রন ফুল ও অনন্য উদ্ভিদজগৎ এই অঞ্চলকে আরো মনোমুগ্ধকর করেছে।
বিশ্বজুড়ে অভিযাত্রী, ট্রেকার ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা একটি স্বপ্নের নাম। ভারতের সিকিম, দার্জিলিং ও নেপালের বিভিন্ন স্থান থেকে এই পর্বতের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। বিশেষ করে দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙিন রূপ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সৃষ্টি করে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু একটি পর্বত নয়, এটি প্রকৃতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও অভিযানের এক মহিমান্বিত প্রতীক। এর সৌন্দর্য, রহস্যময়তা ও পবিত্রতা একে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মানব সভ্যতার কাছে এটি কেবল ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, বরং এক অনন্ত প্রেরণার উৎস।
collected