নিপীড়নের শিকার ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের উচ্ছ্বাস আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকি বদলীতে
আলী আহসান রবি,নিজস্ব প্রতিবেদক.
২২ অক্টোবর ২০২৪
পথিত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ও তার কার্যালয়ের মহাপরিচালক মো. আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকিকে অবশেষে বদলী করা হয়েছে। অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) পদ থেকে সম্প্রতি তাকে পরিকল্পনা কমিশনে বদলী করা হয়েছে। স্বৈরাচারীর দোষর এই কর্মকর্তাকে বদলী করতে আড়াই মাস লাগালো অর্ন্তবর্তী সরকার। এরপরেও এই বদলীতে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন গত ১৫ বছর ধরে নিপীড়নের শিকার কর্মকর্তারা
শেখ হাসিনার গড়ে তোলা জনপ্রশাসন থেকে তার দোসরদের অপসারণ করতে পারেননি। এদিকে গণবিপ্লবের অন্যতম স্পিরিট ছিল, জনপ্রশাসন ও আদালত থেকে শেখ হাসিনার দোসরদের দ্রুত অপসারণ করে ক্লিন করা। তাদের বিচারের আওতায় আনা। এ কাজ এখনো বাস্তবায়ন শুরু করতে পারেনি সরকার। এ বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক সাবেক যুগ্মসচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার ইনকিলাবকে বলেন,উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো:আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকিকে বদলী করায় সরকারকে সাধুবাদ জানাইন। তবে তিনি দীর্ঘদিন এ কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন তার উচিত ছিলো আগেই বদলী নেয়া। আমরা চাই কোনো সরকারি কর্মকর্তা হয়রানি শিকার যেন না হয়। একটি সরকার তাদের ব্যবহার করেছে। আগামীতে সেটি যেন না হয়।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক আদেশে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৭ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনমুলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো:আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকি কে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদে বদলি পূর্বক পদায়নের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নিমিত্ত বর্ণিত কর্মকর্তাকে এ কার্যালয়ের বর্তমান পদেও দায়িত্ব হতে ২১ অক্টোবর অপরাহেৃ অবমুক্ত করা হলো। গত ১৫ বছর ধরে নিপীড়নের শিকার কর্মকর্তারা জানান, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ৪ জন মহাপরিচালককে ওএসডি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে মো.আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকি এসব কাজ করেছেন। জেলা প্রশাসক নিয়োগ কেলেঙ্কারী, আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বহাল রাখার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমগুলোতে এ বিষয়ে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আড়াই মাস লাগালো অর্ন্তবর্তী সরকার। এর পরেও সরকারকে ধন্যবাদ বদলীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। নিপিড়ীত একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আহসান কিবরিয়ার ডান হাত হিসেবে কাজ করেছেন শেখ হাসিনার সরকারের আরেক আস্থাভাজন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা শেখ হাসিনার শাসনামলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আইন অনুবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। আহসান কিবরিয়ার ইশারা ছাড়া বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বা পদায়নের কোন ফাইল তিনি তুলতেন না। এখনও বেশকিছু বঞ্চিত কর্মকর্তার পদায়নের ফাইল তিনি আটকে রেখেছেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নজিরবিহীন বিক্ষোভ, হট্রগোলে জড়ান বঞ্চিত ও বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তারা। এসব ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে দুই দফায় ৫৯টি জেলায় ডিসি নিয়োগ দেয়া হলেও বুধবার ৯টি জেলার ডিসি পদে নিয়োগ দেয়া প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। পাশাপাশি চারজনের পদায়নকৃত জেলা বদল করা হয়েছে। ৫১টি জেলার ডিসি তাদের নতুন পদে যোগদান করেছেন। বিপুল পরিমান আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ত্যাগী, বঞ্চিত ও যোগ্য কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ পরিবার সংশ্লিষ্ট এবং বিগত ১৫ বছরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদেরই আবার ডিসি পদে পুনর্বাসন করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে শতাধিক কর্মকর্তার। ওএসডিও করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে। এছাড়া প্রশাসন সংস্কারে সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মূয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনও শিগগির কাজ শুরু করবে। একই সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য মূয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স যে বাড়ছে এটি মোটামুটি নিশ্চিত।
সরকারের দুই মাস নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলছেন, যে পরিস্থিতিতে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেই অবস্থা থেকে প্রশাসনকে একটা স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় তিন মাস খুবই অল্প সময়। দাবি-দাওয়া, আন্দোলন তাদের অনেকটাই নাজেহাল করেছে। প্রশাসনের পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়, গতিও ধীর। এ গতি বাড়তে হবে। তার মধ্যে তিন মাসেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হামলা পরিকল্পনাকারী ফ্যাসিবাদী আমলাদের চিহিৃতকরণ এবং তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। তাদের চিহিৃত এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গত ১৬ বছরে বঞ্চনা দূর করতে হবে। যাঁরা যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিযোগ্য, তাঁদের দ্রুত পদোন্নতি দিতে হবে। আমরা দীর্ঘ ১৬ বছর বঞ্চনার শিকার। সুতরাং আমাদের আর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেওয়া ঠিক হবে না। শুধু রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী শাসনামলের গত ১৬ বছরে প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন কয়েক শ কর্মকর্তা। গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকায় বঞ্চিত করা হয়। অনেককে বছরের পর বছর ওএসডি থাকতে হয়েছে অথবা গুরুত্বহীন পদে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।
গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ তিনটি পদে একাধিক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন প্রায় দেড় শতাধিক কর্মকর্তা। ভূতাপেক্ষ›তার ভিত্তিতে পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনেকে বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী সচিব হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করেছেন। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পদোন্নতি পেতে দুই বছরের অভিজ্ঞতার দরকার হয়। সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে কিছু কর্মকর্তা আছেন, তাদের সেই শর্তও পূরণ হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কোনো কাজের অভিজ্ঞতা তাদের নেই। এ কারণেই সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে সচিব পদোন্নতি দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই করতে এক বছরের ‹ওয়ার্কিং এক্সপেরিয়েন্স› দেখতে চাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।বৈষম্যের শিকার› বেসামরিক কর্মচারীদের কাছ থেকে পদোন্নতির জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে শীর্ষ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মকর্তা বাছাই করা না গেলে আখেরে সরকারকেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সম্প্রতি সময়ে গণহারে যেসব পদোন্নতি হয়ে গেছে, তার প্রতিফলন সচিব পদের পদোন্নতিতে দেখতে চায় না সরকার। কারণ, সচিবরা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান। তাদের ওপর সেই মন্ত্রণালয়ের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। আর সচিবদের সামগ্রিক কাজের ফলের ওপর নির্ভর করে সরকারের ভাবমূর্তি। তাই ড. ইউনূসের সরকার এই বিষয়টিতে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।