সম্পাদকীয়
অনিয়মের রাহুগ্রাসে নৌপথের দৌরাত্ম্য,আর কত খেসারত
সম্পাদকীয়:
ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ফিরে আসার অনিশ্চয়তার মুখেই চলছে মানুষের জীবনযাত্রা। যাতায়াতের সব পথই যেন অনিরাপদ। গত ৫ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় রঁসকাঠি এলাকাস্থ বাল্কহেডের সাথে সংঘর্ষ হয়ে।আনন্দমুখর একটি পিকনিকের ট্রলার ডুবে সৃষ্ট মর্মস্পর্শী ঘটনাটি। মনে করিয়ে দেয় অতীতের অনেক ঘটনাবলী।
আনন্দভ্রমণ কী মর্মান্তিকভাবে ঢেকে গেছে বিষাদের ছায়ায়স্থলে ।ওই দিন সন্ধ্যাবেলা লৌহজংয়ের তালতলা- গৌরগঞ্জ খালে রসকাঠি এলাকায় পৌঁছলে পিকনিকের ট্রলারটিকে একটি বাল্কহেডের সাথে সংঘর্ষ হয়। ডুবে যাওয়া ওই ট্রলারে আনন্দপিপাসু যাত্রীরা ৪৬ জনের মধ্যে ৮ জনের সলিলসমাধি ঘটে। অনুপুঙ্খ জীবিত ৩২ জনসহ ৮টি লাশ স্থানীয় লোকজন ও লৌহজং ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মীরা উদ্ধার করলেও বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা এই সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত জানা যায়নি।
নৌপথে বাল্কহেডের সংঘর্ষ এমন মর্মস্পর্শী ঘটনা এই প্রথম নয়। একেকটি মর্মন্তদ ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের তরফে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি মিললেও বাল্কহেডের কারণে রাতের নৌপথ এখনও কতটা ঝুঁকিপূর্ণ-তা বিদ্যমান পদ্মার শাখা নদীর রসকাঠি এলাকার সর্বশেষ ঘটনাটিই এর সাক্ষ্যবহ।
সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা দিয়ে ছোট-বড় নৌযানগুলোর বেশিরভাগই সন্ধ্যার পর চাঁদপুর, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। আবার ওইসব এলাকা থেকে রাতের শেষভাগে নৌযানগুলো ফিরে আসে সদরঘাটে। সারাদেশের নৌপথে এমনই চিত্র বিরাজমান । এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে দাপিয়ে বেড়ানোর পথ কতটা বিপদসংকুল, তা ইতোমধ্যে চমকপ্রদ ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনায় প্রতীয়মান হলেও এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব যাদের ; তাদের কার্যক্রম নৌপথে বিশেষ করে রাতের বেলা বাল্কহেড মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা জানি, রাতের নৌপথে বাল্কহেড চলাচল বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবে কার্যকর নয় বললেই চলে । আটকে আছে উচ্চারণ সর্বস্ব অঙ্গীকার কিংবা কাগজপত্রে বন্দী সিদ্ধান্তের মাঝে। নৌপুলিশ ও কোস্ট গার্ডের দায়িত্বশীল অসাধুদের ‘ম্যানেজ’ করে বৈধ-অবৈধ নৌযানগুলো নদীপথ দাপিয়ে বেড়ানোর খবর নতুন কিছু নয়। সন্ধ্যা পর নৌপথে বাল্কহেড চলাচল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অদৃশ্য শক্তির জোরে রাতে সেগুলো চলছেই, এই প্রশ্ন ইতঃপূর্বে সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা রেখেছিলাম। কিন্তু বিস্ময়কর,
ওই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে ফের বিপন্ন মানুষের আর্তনাদে বেদনার যে গাঢ় ছায়া বিস্তৃত হলো- এর দায় কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল গুলো এড়াতে পারবে না। একেকটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটবে, এরপর সংবাদমাধ্যমসহ জনপরিসরে এ নিয়ে হইচই হবে,স্বজন হারানোর হাহাকার ছেয়ে যাবে, আবার তা মিইয়ে যাবে- এভাবে আর কতদিন? এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির শিকার আর কত নৌপথ যাত্রীকে হতে হবে- এই প্রশ্ন বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমরা রাখি এবং এর সদুত্তর চাই। পদ্মার শাখা নদী ট্রলারডুবির ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়,
এটি স্পষ্টতই নিয়মনীতি লঙ্ঘনের ও স্বেচ্ছাচারিতার ভয়াবহ বিরূপ ফল। আমরা এই ঘটনায় শোক ও সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি ক্ষুব্ধতার সঙ্গে এ প্রশ্নও রাখি- অনিয়মের প্রতিফল কি মানুষের কপালে, দুর্ভাবনার ভাঁজ ফেলতেই থাকবে? নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাল্কহেড চলাচলের বিষয়ে ইতোমধ্যে
গণমাধ্যমের নানাবিধ জিজ্ঞাসাসূচক অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দায়হীনতার গাফলতি ঘুচছে না। আমরা মনে করি, নিয়মনীতি কিংবা বিধিনিষেধের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাদের দাপট মানুষের সর্বনাশের কারণ হয়ে আছে, তাদের অদৃশ্য শক্তির উৎস কোথায় এর অনুসন্ধান করে দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারে আর কালক্ষেপণের অবকাশ নেই।
রাতে বাল্কহেড চলাচল বন্ধে মাঝেমধ্যে দায়িত্বশীলদের অভিযান পরিচালিত হয় বটে, কিন্তু তা যে নিছক লোক দেখানো তা বলবার উপেক্ষা রাখে না, স্রামপ্রতি সময়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি এর সাক্ষ্য দেয়। বিস্ময়কর,দুঃখ হলেও সত্য, এ যাবৎ ঘটে যাওয়া এমন মর্মস্পর্শী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুস্থ আইনানুগ ব্যবস্থাক্রমে দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির নজির বিরল। অভিযুক্তদের উপযুক্ত বিচার না হওয়ার কারণেই বিভীষিকাময় পরিসর উৎপত্তির বিস্তৃত হচ্ছে।
প্রশাসনের মৌনতার পেছনে কোন তাপশক্তি ক্রিড়াশীল- এরও অনুসন্ধান সমভাবেই জরুরি। অভিযোগ আছে, সাধারণত নদী থেকে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে তা পরিবহনে বাল্কহেড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন এবং নৌপুলিশ, কোস্ট গার্ড কোনো পক্ষেরই এই কারণগুলো অজানা থাকার কথা নয়, তা নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে ।
মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় মর্মান্তিক সর্বশেষ ঘটনাটি আমাদের ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার নির্বিকারত্ব। লৌহজং উপজেলার মর্মান্তিক ঘটনার কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপশি সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিবিধানেরও আমরা দাবি জানাই। বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নৌ-ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ অবিলম্বে এর প্রতিকার প্রতিহত করার জোর দাবী জানাই। নৌপথের জনস্বার্থের প্রাণরক্ষার বৃত্তিতে।
·•লেখক_কলামিষ্ট—মোঃ ইব্রাহিম খলিল