অ্যামাজন জঙ্গল বিশ্বজুড়ে অভিযাত্রী, প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে আকর্ষণীয়
বিলাল হুসাইন:অ্যামাজন জঙ্গল বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্য। এটি দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশে বিস্তৃত, যার মধ্যে ব্রাজিলে সবচেয়ে বড় অংশ অবস্থিত। বিশ্বের মোট গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনের প্রায় অর্ধেক জুড়ে রয়েছে এই বিশাল অরণ্য। প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই জঙ্গলকে বলা হয় “পৃথিবীর ফুসফুস” কারণ এটি বিশ্বে উৎপাদিত অক্সিজেনের একটি বড় অংশ সরবরাহ করে। অ্যামাজন জঙ্গল শুধু আয়তনের জন্য নয়, জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিবেশগত গুরুত্বের জন্যও পৃথিবীর অনন্য এক সম্পদ।
অ্যামাজন জঙ্গল দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশে ছড়িয়ে আছে—ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা। এর মধ্যে প্রায় ৬০% ব্রাজিলে অবস্থিত। বিশাল অ্যামাজন নদী ও তার উপনদীগুলো এই অরণ্যের প্রাণকেন্দ্র। অ্যামাজন নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬,৯৯২ কিলোমিটার, যা বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী এবং জলধারার দিক থেকে প্রথম।
অ্যামাজন জঙ্গল নিরক্ষরেখার কাছাকাছি হওয়ায় এখানে সবসময় গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া বিরাজ করে। সারা বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, বছরে গড়ে প্রায় ২,০০০ মিলিমিটার থেকে ৩,০০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়। তাপমাত্রা সাধারণত ২৫°C থেকে ২৮°C এর মধ্যে থাকে। এই উষ্ণ ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াই এই জঙ্গলে বিপুল জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি করে।
অ্যামাজন জঙ্গল বিশ্বের সর্বাধিক জীববৈচিত্র্যময় অঞ্চল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন এখানে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন গাছপালা রয়েছে, যা প্রায় ১৬,০০০ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।
এখানে ৪০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১,৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪০০-এর বেশি উভচর প্রাণী এবং প্রায় ২৫ লক্ষ কীটপতঙ্গ রয়েছে। বিখ্যাত প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে জাগুয়ার, টাপির, স্লথ, অ্যানাকোন্ডা, পিরানহা, অ্যামাজন নদীর ডলফিন ইত্যাদি।
বিশাল এই বনে রয়েছে রাবার গাছ, মহগনি, সিডার, অর্কিড, ব্রোমেলিয়াডসসহ অগণিত গাছপালা ও ফুল। অনেক উদ্ভিদ এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা।
এখানে এমন অনেক প্রজাতি রয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। প্রতি বছর নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে।
অ্যামাজন নদী পৃথিবীর সবচেয়ে জলবহুল নদী। এর প্রায় ১,১০০টির বেশি উপনদী রয়েছে। এই নদী ও তার শাখা-প্রশাখা পুরো অরণ্যকে সজীব রেখেছে। বর্ষাকালে নদী উপচে গিয়ে বিশাল এলাকা প্লাবিত করে এবং শুকনো মৌসুমে আবার পানি কমে আসে। নদীর মাছ ও জলজ প্রাণী স্থানীয় মানুষের প্রধান খাদ্য।
অ্যামাজন জঙ্গলে প্রায় ৪০০–৫০০ আদিবাসী উপজাতি বাস করে। এদের মধ্যে কিছু উপজাতি আধুনিক সভ্যতার সাথে যোগাযোগ করেছে, আবার কিছু উপজাতি এখনো বাইরের বিশ্বের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে না। এই মানুষগুলো শিকার, মাছ ধরা, চাষাবাদ ও বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার আছে। অনেক উপজাতি প্রাকৃতিক পরিবেশকে দেবতা হিসেবে মানে এবং বনকে রক্ষা করার জন্য নানা আচার পালন করে।
অ্যামাজন জঙ্গলকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। এখানে গাছপালা প্রতিনিয়ত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু ভারসাম্য রক্ষিত হয়। এছাড়াও এই জঙ্গল বৃষ্টিপাতের চক্র, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি অ্যামাজন জঙ্গল ধ্বংস হয় তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আরও তীব্র হবে।
অ্যামাজন জঙ্গলে অসংখ্য ঔষধি উদ্ভিদ রয়েছে, যেগুলো থেকে নানা ওষুধ তৈরি হয়। যেমন—কুইনাইন নামক ওষুধ ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যা সিঙ্কোনা গাছ থেকে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে অ্যামাজন জঙ্গলে আরও অনেক উদ্ভিদ রয়েছে, যা ভবিষ্যতে ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ জটিল রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অ্যামাজন জঙ্গল আজ গুরুতর সংকটের মুখে। প্রধান কারণগুলো হলো—
সয়াবিন চাষ, গবাদি পশুর খামার এবং কৃষিজমি তৈরি করতে ব্যাপকভাবে বন কাটা হচ্ছে।
মেহগনি ও অন্যান্য মূল্যবান কাঠ বাণিজ্যের জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে।
সোনা ও অন্যান্য খনিজ আহরণের জন্য অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে এবং বিষাক্ত রাসায়নিক নদীতে মিশে যাচ্ছে।
ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে জমি পরিষ্কার করা হয়, যা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হেক্টর বন ধ্বংস করে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তনের কারণে অ্যামাজন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন যে, যদি ধ্বংসের হার এভাবেই চলতে থাকে তবে কয়েক দশকের মধ্যে অ্যামাজনের বড় অংশ হারিয়ে যাবে।
অ্যামাজনকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পরিবেশবাদীরা কাজ করছে। বন রক্ষায় আইন করা হয়েছে, সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করা হয়েছে এবং টেকসই কৃষি ও বন ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে। জাতিসংঘ, WWF, Greenpeace প্রভৃতি সংগঠন এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াচ্ছে। তাছাড়া অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক অ্যামাজনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করছেন।
অ্যামাজন জঙ্গল বিশ্বজুড়ে অভিযাত্রী, প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে আকর্ষণীয়। ব্রাজিল, পেরু, ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার বিভিন্ন শহর থেকে জঙ্গল ভ্রমণের সুযোগ আছে। জঙ্গল সাফারি, নৌকাভ্রমণ, পাখি দেখা, এবং আদিবাসী গ্রাম পরিদর্শন পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে পর্যটন অবশ্যই পরিবেশবান্ধব হতে হবে, যাতে বন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
অ্যামাজন জঙ্গল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি শুধু দক্ষিণ আমেরিকার নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। জীববৈচিত্র্য, অক্সিজেন উৎপাদন, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, ঔষধি উদ্ভিদ—সবকিছু মিলিয়ে অ্যামাজন মানবসভ্যতার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু নির্বিচারে বন ধ্বংসের কারণে এটি আজ চরম ঝুঁকির মুখে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো এই অরণ্যকে রক্ষা করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী পায়।
collected