আসন্ন রমজান মাসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রম এবং বিগত ৬ মাসে মন্ত্রণালয়ের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে
সংবাদ সম্মেলন
বিলাল হুসাইন,চিফ রিপোর্টার:
তারিখ: ১৭.০২.২৫ খ্রি.
স্থান: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষ
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
আর কিছুদিন পরেই পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে যাচ্ছে। সকলকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় স্ব স্ব ক্ষেত্রে রমজান মাসে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজ করছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যেহেতু খাদ্য দ্রব্যের উল্লেখযোগ্য পণ্য সরবরাহ করে তাই আমাদের পরিকল্পনা আপনাদের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে চাই। পাশাপাশি বিগত ছয় মাসে মৎস্য অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে চাই। আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে আসার জন্যে আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
১। ঢাকা শহরে পবিত্র রমজান মাসে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ সরবরাহ:
আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার নিমিত্তে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে
(ক) ১লা রমজান থেকে ২৮শে রমজান পর্যন্ত ঢাকা শহরে ড্রেসড ব্রয়লার, ডিম, পাস্তুরিত দুধ ও গরুর মাংস এবং সারাদেশে ব্রয়লার, ডিম, পাস্তুরিত দুধ, গরুর মাংস ও খাসির মাংস সুলভ মূল্যে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এ কার্যক্রমে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি), বাংলাদেশ ডেইরি এন্ড ফ্যাটেনিং ফারমার্স এসোসিয়েশন (বিডিএফএফএ) এবং দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য অংশীজন এবং প্রান্তিক খামারিগণ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করবেন।
(খ) প্রাণিজ পণ্যের সুলভ মূল্য নিশ্চিতকরণ:
ড্রেসড ব্রয়লার মাংস (প্রতি কেজি) ২৫০ টাকা
দুধ পাস্তুরিত (প্রতি লিটার) ৮০ টাকা
ডিম (প্রতি ডজন) ১১৪ টাকা
গরুর মাংস (প্রতি কেজি) ৬৫০ টাকা
(গ) ঢাকা শহরের ২৫ টি স্থানে সুলভ মূল্যে প্রাণিজাত পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে জুলাই বিপ্লবের সময় যে সকল স্থানে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহন বেশি ছিল সে সকল স্থানকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে এবং বস্তি এলাকায় বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। এই এলাকাগুলো হচ্ছে
১। সচিবালয়ের পাশে (আব্দুল গণি রোড)
২। খামারবাড়ী (ফার্মগেট)
৩। ষাটফুট রোড (মিরপুর)
৪। আজিমপুর মাতৃসদন (আজিমপুর)
৫। নয়াবাজার (পুরান ঢাকা)
৬। বনশ্রী
৭। হাজারীবাগ (সেকশন)
৮। আরামবাগ (মতিঝিল)
৯। মোহাম্মদপুর (বাবর রোড)
১০। কালশী (মিরপুর)
১১। যাত্রাবাড়ী (মানিক নগর গলির মুখে)
১২। শাহাজাদপুর (বাড্ডা)
১৩। কড়াইল বস্তি, বনানী
১৪। কামরাঙ্গীর চর
১৫। খিলগাঁও (রেল ক্রসিং দক্ষিণে)
১৬। নাখাল পাড়া (লুকাস মোড়)
১৭। সেগুন বাগিচা (কাঁচা বাজার)
১৮। বসিলা (মোহাম্মদপুর)
১৯। উত্তরা (হাউজ বিল্ডিং)
২০। রামপুরা (বাজার)
২১। মিরপুর ১০
২২। কল্যাণপুর (ঝিলপাড়)
২৩। তেজগাঁও
২৪। পুরান ঢাকা (বঙ্গবাজার)
২৫। কাকরাইল
(ঘ) প্রতিদিন সম্ভাব্য বিক্রয়ের পরিমান:
ডিম: ৬০ হাজার পিস
পাস্তুরিত দুধ: ৬ হাজার লিটার
ড্রেসড্ ব্রয়লার: ২ হাজার কেজি
গরুর মাংস: ২০০০-২৫০০ কেজি
(ঙ) পবিত্র মাহে রমজানের এই বিপণন কার্যক্রম আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ সকাল ১০:৩০ টায় সিরাজ মিয়া মেমোরিয়াল মডেল স্কুল প্রাঙ্গণ, দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক এলাকা (ডিআইটি প্রজেক্ট), মেরুল বাড্ডা, ঢাকায় উদ্বোধন করা হবে।
২। পবিত্র রমজান মাসে সারাদেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কার্যক্রম:
(ক) ঢাকা শহর ছাড়াও সারা দেশব্যাপী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আয়োজনে জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সমন্বয়ে পবিত্র মাহে রমজানে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে প্রান্তিক খামারিগণকে সম্পৃক্ত করে বিপণন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
(খ) বিভাগীয়/জেলা/উপজেলা শহরে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়:
বিভাগীয়/জেলা/উপজেলা পর্যায়ে প্রান্তিক খামারিদের সমন্বয়ে ড্রেসড ব্রয়লার, দুধ, ডিম, গরুর মাংস ও খাসির মাংস সুলভ মূল্যে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
প্রতিটি উপজেলাতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে গত ১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে শুরু হয়ে অদ্যাবধি ৮ বিভাগের ৬১টি জেলার ৩৬৪ উপজেলায় মোট ৩৭৭টি পয়েন্টে সুলভ মূল্যে ডিম বিক্রি কার্যক্রম চলমান আছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত দেশে প্রায় ২২ লক্ষ ৩৩ হাজার ৮৭ পিস ডিম বিক্রি হয়েছে। রমজানেও এ সকল পয়েন্টে সুলভ মূল্যে ডিম বিক্রয় কার্যক্রম চলমান থাকবে।
(গ) যেহেতু রমজান মাসে মাছের দাম সাধারণ বাজারে মোটামুটি স্থিতিশীল থাকে, তাই আলাদাভাবে কোন কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে না, তবে বিএফডিসি’র বিক্রয় কেন্দ্রে সামুদ্রিক মাছ, কাপ্তাই লেক থেকে আহরিত রেডি টু কুক ফিস পাওয়া যাবে। ইলিশের মৌসুম না হওয়ায় এখন ইলিশ মাছ দেয়া যাচ্ছে না।
প্রাণিসম্পদের জন্যে সুখবর, লাম্পি স্কিন ডিসিজ ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন ও উৎপাদন
(ক) সারাদেশে গবাদিপশুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (LSD) এর কারণে দেশের খামারিরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু খুব দ্রুত এই রোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে এ রোগ খামারিদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ। এই রোগের আক্রান্তের হার প্রায় ৩০% এবং আক্রান্ত গবাদি পশু ৫-১০% মারা যায়, যা খামারিদের জন্য খুব উদ্বেগের কারণ। সরকার ভ্যাক্সিন আমদানির মাধ্যমে এই রোগের মোকাবেলা করছেন যা খুব ব্যয় সাপেক্ষ। এর ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। আমদানি করা ভ্যাক্সিনের দাম কোম্পানি ভেদে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত হলেও সরকার LSD ভ্যাকসিন উৎপাদনসহ গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করতে ৫০ টাকার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে। আমরা আনন্দিত যে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাকসিনের সিড তৈরি করেছে। উক্ত সিড গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ অধিদপ্তরের অধীন প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এলআরআই), মহাখালীতে সিড থেকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
(খ) সেল কালচার পদ্ধতিতে এ রোগের ভ্যাকসিন তৈরি হয় বিধায় আনুমানিক ৩ মাসের মধ্যে এ ভ্যাকসিনের ১ম লট জেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে মাঠে এ ভ্যাকসিন সীমিত ব্যবহার করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে যাতে খামারিগণ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা পান। ভ্যাক্সিন উৎপাদিত হয়ে গেলে মাঠ পর্যায়ে এলএসডি ভ্যাক্সিনের মূল্য ৫০ টাকা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে উৎপাদন কাজ পুরোদমে শুরু হওয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে LSD ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণ করা হবে।
বিসিএস লাইভস্টক একাডেমি, সাভার, ঢাকার মূল গেটের নাম ‘শহিদ সাফওয়ান সদ্য’ নামে নামকরণ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ এর দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ‘সাফওয়ান আখতার সদ্য’ গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। তার স্মরণে বিসিএস লাইভস্টক একাডেমি, সাভার, ঢাকার মূল গেট ‘শহিদ সাফওয়ান সদ্য’ নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অতিশীঘ্রই আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ সাফওয়ান সদ্য নামের গেটটি উদ্বোধন করা হবে।
মৎস্য সংক্রান্ত কার্যক্রম
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এবং বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) এর মাধ্যমে বেশ কিছু কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে।
১। জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে কার্যক্রম:
ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম’ বা ban period ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর, ২০২৪ (২২ দিন) সফলভাবে পালিত হয়েছে। আশ্বিন মাসের একটি পূর্ণিমা এবং একটি অমাবস্যার আগে ও পরে ৩ (তিন) দিন ধরে আশ্বিন-কার্তিকে মা ইলিশ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সময়ে সারাদেশে সাগরসহ নদ-নদীতে ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহণ, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিপণন নিষিদ্ধ করে মৎস্য অধিদপ্তর প্রজ্ঞাপন জারি করে। মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রশাসনসহ সকল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে নৌ বাহিনী, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড এর সহযোগিতায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই কার্যক্রমের কারণে ২০০৬ সাল থেকে ইলিশের আহরণ ১০৪.৬৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলাফল বিএফআরআই নিরূপণ করেছেন।
২০২৪ সালের মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিন নিষেধাজ্ঞার সামগ্রিক প্রজনন সফলতার হার ৫২.৫% এবং ৪৪ কোটি জাটকা/রেণু ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে, যা বিগত বছরের তুলনায় ৩.৬৬ কোটি বেশি। ২০২৪ সালে প্রতি একক প্রচেষ্টায় ধৃত জাটকার পরিমাণ (Catch per unit) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দেড় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রজনন সফলতার ইঙ্গিত দেয় এবং পরীক্ষামূলক জালে ৯১% ইলিশ লার্ভি পাওয়া গেছে, যা নিষেধাজ্ঞার সময়ে উৎপাদনের সাফল্য নির্দেশ করে। একই সাথে অন্যান্য মাছের লার্ভিও উল্লেখযোগ্য হারে পাওয়া গেছে অর্থাৎ জলজ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা পেয়েছে।
২। বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমা ও হাওরে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন:
(ক) সামুদ্রিক জলসীমায়ও ইলিশ ও অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য আহরণের ওপর প্রতি বৎসর ২০ মে হতে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ (পঁয়ষট্টি) দিন সকল প্রকার মৎস্য নৌযান কর্তৃক যে কোন প্রকার মৎস্য ও চিংড়ি, কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি (ক্রাস্টাশিয়ান্স) আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ১২.৭৮% বৃদ্ধির রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এই সময়কাল পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সমন্বয় না থাকায় বাংলাদেশের মাছ আহরণে পার্শ্ববর্তী দেশের মৎস্যজীবীরা সুযোগ নিচ্ছে। তাই মৎস্য আহরণকারী সংগঠন এবং মৎস্যজীবীগণ কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ব্যান পিরিয়ড সমন্বয় করার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে।
তারই প্রেক্ষিতে মৎস্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য অংশীজন এবং মৎস্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। কারিগরি কমিটি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের স্থায়িত্বশীল আহরণ ও স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ মাছের Breeding Period এপ্রিল থেকে জুন মাস হওয়ায় ১৫ এপ্রিল হতে ১১ জুন পর্যন্ত মোট ৫৮ দিন বঙ্গোপসাগরে সকল ধরনের মৎস্য আহরণ বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে সামুদ্রিক জলসীমায় ইলিশ ও অন্যান্য মাছের আহরণের নিষিদ্ধ কাল হচ্ছে ৫৮ দিন (১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন)।
(খ) হাওরে দেশীয় মাছ সংরক্ষণের জন্য ১৫ মে হতে ১৪ জুন পর্যন্ত হাওরে পানি আসার প্রেক্ষিতে ২০ দিন বা সর্বোচ্চ ১ (এক) মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে।
৩। ইলিশের প্রাপ্যতা এবং ইলিশের দাম:
(ক) ইলিশের প্রাপ্যতা:
ইলিশ মূলত সামুদ্রিক এবং পরিব্রাজনশীল মাছ। প্রজননের জন্য লোনা পানি হতে স্বাদু পানির নদ-নদীতে পরিব্রাজন করে এবং ডিম ছাড়ে। প্রজনন শেষে পুনরায় সাগরে ফিরে যায়। সারা বছর কম-বেশী ডিম ছাড়ে। তবে অক্টোবর-নভেম্বরের (প্রথম সপ্তাহ) সর্বাধিক প্রজনন হয়। ইলিশ মাছ সাগর থেকে স্বাদু পানির নদ-নদীতে পরিব্রাজনের কারণে নদ-নদীতে সারা বছর পাওয়া যায়। আবার সাগরে বছরের সব সময় ইলিশ পাওয়া যায়। ইলিশের এ ধরনের জীবন চক্রের কারণে সারা বছর আহরিত ইলিশ বাজারে পাওয়া যায় (ইলিশ ধরা বন্ধকালীন সময় ছাড়া)। তবে বাজারে সবচেয়ে কম পাওয়া যায় শীতকালে (ডিসেম্বর- ফেব্রুয়ারি)।
বর্তমানে ইলিশ আহরণের প্রধান মৌসুম না হওয়ায় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম। তবে আগামী এপ্রিল থেকে সরবরাহ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। যেমন, বরিশালের পোর্ট রোডে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৬-৮ হাজার কেজি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে অথচ প্রধান মৌসুমে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) দৈনিক গড়ে ৪০-৪৮ হাজার কেজি সরবরাহ হয়ে থাকে।
(খ) ইলিশের দাম:
বাজারে ইলিশের সরবরাহ মৌসুম অনুযায়ী কম বেশি হয়। সাধারণত এক কেজি নদীর ইলিশের দাম গড়ে ২০০০-২২০০ টাকা এবং সাগরের ইলিশ এক কেজি ১৬০০-১৮০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। বাজারের এই দাম অত্যন্ত বেশি এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রতি কেজি ইলিশের দাম এখনও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে যা মোটেও কাম্য নয়।
ইলিশের দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায় যে, ইলিশের আহরণের সাথে জড়িত মৎস্যজীবিদের খরচ দিনে দিনে বাড়ছে। ২০২১ সালে ডিজেল ও পেট্রোলের দাম ছিল যথাক্রমে লিটার প্রতি ৮০ ও ৮৬ টাকা যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ১১৪ ও ১৩০ টাকা হয়। ট্রলারে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ডলারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমিকদের বেতন ভাতা খাতে খরচ বৃদ্ধি, প্রান্তিক জেলেদের আর্থিক সংকট থাকায় এ খাতে দাদন ব্যবসা, কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা না থাকা ইত্যাদি নানা কারণে ইলিশের মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশী রয়েছে। তাছাড়া বাজারে মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্মের কারণেও ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
সরকার এই বিষয়ে কাজ করছে। তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর কাজ সফল হলে সরবরাহ বাড়বে। ইলিশ মাছের সরবরাহ ও মূল্যশৃঙ্খলে (Supply and value chain) বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের মাধ্যমে মূল্য হ্রাসের লক্ষ্যে হ্রাসকৃত মূল্যে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন এর মাধ্যমে ভোক্তাদের নিকট বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ১ম ও ২য় লট আকারে সর্বমোট দৈনিক প্রায় ২ টন ইলিশ ১৬০০ জন ক্রেতার কাছে ১০ লক্ষ ১১ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। গড়ে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ছিল ৬০০ টাকা। বর্তমানে ইলিশের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় এই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে, তবে পর্যাপ্ত সরবরাহের প্রেক্ষিতে পুনরায় এ ধরনের জনবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
৪। অবৈধ জাল বন্ধের জন্য অভিযান:
সাগর এবং নদীতে ইলিশ উৎপাদন সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে অবৈধ জাল যেমন- বেহুন্দি জাল, কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধের জন্য অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণের জন্য নৌপুলিশ, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী দ্বারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এ সকল অভিযানে মোট ১৮৩ মেট্রিক টন ইলিশ/জাটকা, ৬৯ মেট্রিক টন অন্যান্য মাছ, ৪ হাজারটি বেহুন্দি জাল, ১৬ কোটি ৪৪ লক্ষ মিটার কারেন্ট জাল এবং ২০ হাজার অন্যান্য জাল আটক করা হয়।
মুন্সীগঞ্জের ৫৭ কারখানায় অবৈধভাবে কারেন্ট জাল উৎপাদন করা হয়। ০৮.০৮.২৪ তারিখ হতে ১৫.০২.২৫ তারিখ পর্যন্ত ১৪৬ টি অভিযানের মাধ্যমে ৮ কোটি মিটার কারেন্ট জাল, প্রায় ৯ লক্ষ রিল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। অভিযানের ফলে ১২ টি জাল উৎপাদনকারী কারখানা ও ৭ টি আয়রন কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও ০৭ টি অবৈধ কারখানা বৈধ জাল উৎপাদনের কারখানায় রূপান্তরিত হয়েছে।
কারেন্ট জালের বিরুদ্ধে অভিযানের পাশাপাশি পাঙ্গাসের পোনা ধরার জন্য ব্যবহৃত চাঁই এর বিরুদ্ধেও অভিযান জোরদার করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, ভোলা জলার মনপুরা, চরফ্যাশন ও নোয়াখালী জেলার হাতিয়ায় ৪০টি অভিযানের মাধ্যমে ১৩৪টি বৃহৎ আকারের চাঁই জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। এ চাঁইসমূহে আটকে পড়া প্রায় ১০ হাজার কেজি (প্রায় ৬ লক্ষ টি) জীবিত পোনা মাছ নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও চাঁই পাতার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ৮টি নৌকা জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। এতে আশা করা যায় যে আগামী বছর নদীতে প্রচুর পাঙ্গাস মাছ উৎপন্ন হবে এবং জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
৫। মৎস্যজীবীদের ভিজিএফ প্রদান সংক্রান্ত তথ্য:
মা ইলিশ সংরক্ষণ, জাটকা সংরক্ষণ, ৬৫ দিন সমুদ্রে মৎস্য আহরণ বন্ধকালীন ১২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৬৯৮ জন জেলেকে মোট ৮১ হাজার ২৬৭ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) প্রদান করা হচ্ছে। যার বিবরণ নিম্নরূপ:
মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে ৫ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫৬৫ জন মৎস্যজীবীকে ২৫ কেজি হারে ১৪ হাজার ১৬৪ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) প্রদান করা হয়।
জাটকা সংরক্ষণ অভিযানে (ফেব্রুয়ারি-মে) ০৪ মাসের জন্য ৩ লক্ষ ৬১ হাজার ৭১ জন মৎস্যজীবীকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৫৭ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) প্রদান করা হয়।
সমুদ্রে প্রতি বছর ২০ মে-২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ বন্ধ কর্মসূচিতে ৩ লক্ষ ১১ হাজার ৬২ জন মৎস্যজীবীকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৯ হাজার ৩৩২ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) প্রদান করা হয়।
এছাড়াও কাপ্তাই লেকে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধকালীন (প্রতিবছর মে-জুলাই) ০৩ মাসের জন্য রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার ২৬ হাজার ৭৫১ জন মৎস্যজীবীকে মাসিক ২০ কেজি হারে ১ হাজার ৬০৫ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) প্রদান করা হয়।
হাওর অঞ্চলে প্রজনন মৌসুমে মৎস্য সংরক্ষণ সময়কালীন ২ লক্ষ ৭১ হাজার ৮৮০ জন মৎস্যজীবীকে মাসিক ৫০ কেজি হারে ১৩ হাজার ৫৯৪ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
৬। প্রবাসি বাংলাদেশীদের জন্য ইলিশ সরবরাহ:
ইলিশ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে ২০১২ সাল থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ আছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫.৩০ লক্ষ মেট্রিক টন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের মানুষের জন্যে ইলিশ সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে সচেষ্ট। পাশাপাশি, বাংলাদেশের মানুষ যারা বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন এবং দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার পাশে সোচ্চার ছিলেন, তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সীমিত আকারে ইলিশ মাছ রপ্তানির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সারা বছর পাঠানো না গেলেও অধিক ইলিশ প্রাপ্তির সময় [আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে] প্রবাসিদের জন্য ইলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET) এর তথ্য অনুযায়ী সর্বাধিক প্রবাসী কর্মজীবী আছেন সৌদি আরবে প্রায় ৪৪ লক্ষ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ২২ লক্ষ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হতে প্রাথমিক অবস্থায় দুটি দেশে মোট ১১ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে। এ বছর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যা কার্যকর করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর অন্যান্য দেশে পাঠানোর বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে।
৭। সুবিধাভোগী নির্বাচন ও মৎস্যজীবী তালিকা হালনাগাদকরণ:
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী (Social Safety Net Programs- SSNPs) আওতায় মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে জেলেদের ভিজিএফ প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে সুবিধাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে লিকেজ (অযাচিত প্রাপক অন্তর্ভুক্ত হওয়া) ও ত্রুটি বিচ্যুতি (যারা প্রাপ্য, তারা বাদ পড়া) দেখা যায়। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ভোলা জেলার ভোলা সদর, মনপুরা, চাঁদপুর জেলার চাদঁপুর সদর এবং খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা- এ ৪টি উপজেলায় বিদ্যমান তালিকা হতে অ-মৎস্যজীবীদের বাদ দেয়া এবং প্রকৃত জেলেদের অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য পাইলট ভিত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়েছে। পাইলট প্রোগ্রামের অভিজ্ঞতা দিয়ে সারাদেশের প্রকৃত জেলের তালিকা হালনাগাদ করা হবে।