কুয়াকাটায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কক্ষ পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ, ফেইসবুকে সমালোচনার ঝড়,
নিজস্ব প্রতিবেদক:
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছে শিক্ষকরা। একটি ভবনের বেশ কয়েকটি ক্লাস রুমকে গেস্ট হাউজ বানিয়ে নিয়মিত পর্যটকদের কাছে ভাড়া দিচ্ছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আর সেই গেস্ট হাউজের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কুয়াকাটা বি.বি গেস্টে হাউজ’। দীর্ঘদিন যাবত এ বাণিজ্য চললেও জানে না উপজেলা প্রশাসন কিংবা শিক্ষা বিভাগ এমনটাই দাবি তাদের। বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি বাবদ প্রকারভেদে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে। অর্ধ বার্ষিক ও বার্ষিক পরিক্ষার সময় নেয়া হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে। বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট বিল, মসজিদ চাঁদা, কোচিং ফি, বেতন সহ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে এসব টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হলেও এর কোন সঠিক হিসাব নেই স্কুল পরিচালনা কমিটির কাছে। কোন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে এসব টাকা তাও কেউ জানেন না।
গত কয়েক বছর ধরে নিয়মনীতি অনুসরণ না করেই বিদ্যালয়ের দুটি ভবনের একটিকে গেস্ট হাউজ বানিয়ে নিয়মিত পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর কুয়াকাটায় পর্যটকদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাড়াও হচ্ছে নিয়মিত। তবে এ গেস্ট হাউজের ভাড়া কোথায় যাচ্ছে কিংবা কে কি খাতে ব্যয় করছেন এর সঠিক কোনো হিসাব নেই।
বিষয়টি নিয়ে রোববার (৯ জুলাই) রাতে কুয়াকাটা পৌর ছাত্রলীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ কাওছার ও পৌর কৃষকলীগের নেতা তুহিন দেওয়ান তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন।
সেখানে তারা লেখেন, কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয় কুয়াকাটা পৌরসভার একটি মাত্র হাই স্কুল। ঈদের ছুটির পর আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। কিন্তু বিকেলে খেলা দেখার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে দেখলাম কিছু পর্যটক ধূমপান করছেন এবং শিক্ষার্থীদের সামনে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন- আমরা ঘুরতে আসছি ভাড়া নিয়ে থাকছি এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। অনেক দিন আগে থেকেই স্কুলের একটি ভবনকে কর্তৃপক্ষ আবাসিক হোটেল বানিয়েছে। প্রতিদিন ভাড়া দিচ্ছে। এখানে খারাপ লাগার বিষয় হচ্ছে একটা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন বহিরাগত লোক আসছে এবং শিক্ষার্থীরা বিব্রত হচ্ছে।
এ ছাত্রলীগ ও কৃষকলীগ নেতা আরও লিখেন, বুঝলাম টাকা স্কুলের খাতেই ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গেস্ট ভাড়া দেয় না বলে কি চলে না? কিংবা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কী স্কুল চলতো না? এটা আমার ব্যক্তিগত মত। কোনো স্যারদের উদ্দেশ্যে করে নয়, একজন সচেতন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে খারাপ লাগাটা প্রকাশ করলাম।
এদিকে ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পর্যটকদের সঙ্গে এক যুবক কথা বলছেন, এতে পর্যটকরাও কিছুটা বিব্রত। তাদের সঙ্গে কথপোকথনে জানা যায় স্কুলের একজন স্টাফ পর্যটকদের ডেকে এনে ভাড়া দিয়েছেন। তাদের রুমের চাবি রিংয়ে কুয়াকাটা বি.বি গেস্ট হাউজ লেখা আছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন পোস্ট নিয়ে ফেইসবুকে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেখানে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন ধরনের কমেন্ট করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদকে নিয়ে কটাক্ষ করা হয। এতে টনক নড়ে উপজেলা প্রশাসনের।
সোমবার সকালে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন সরেজমিনে বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে এর সত্যতা পান। তাৎক্ষণিক তিনি বিবি গেস্ট হাউসের সাইনবোর্ড খুলে ফেলেন এবং রুমে থাকা খাট, ফার্নিচার অপসারণ করে ওই গেস্ট হাউস বন্ধ করে দেন।
স্থানীয়দের অনেকেই জানান, গত কয়েক বছর আগে বঙ্গবন্ধু বিদ্যালয়ের একটি টিন সেট ভবনে প্রধান শিক্ষক মোঃ খলিলুর রহমান নার্সারি স্কুল খোলেন। পরে অভিভাবক ও স্থানীয়দের চাপের মুখে গত দুই বছর হলো বন্ধ করা হয় ওই নার্সারি স্কুলটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক জেলে ও দিন মজুর শ্রেণির। এসব অভিভাবকরা স্কুলের ধার্যকৃত অতিরিক্ত ফি দিতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক অভিভাবকরা জানান, সরকারি স্কুল হলেও এই স্কুলে লেখাপড়ার খরচ প্রাইভেট স্কুলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাদের অভিযোগ স্কুলটি এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শুন্য রয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ খলিলুর রহমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। হঠাৎ করে গত দুই বছর আগে থেকে কাগজপত্রে নিজেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্বাক্ষর করছেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি না হলেও শিক্ষা দপ্তরে এই স্কুলের প্রেরিত সকল কাগজপত্রে ভারপ্রাপ্তের স্থলে সরাসরি প্রধান শিক্ষক হিসেবে সীল স্বাক্ষর করছেন। শিক্ষা অফিসও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। পদোন্নতি না পেয়েও নিজেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দেয়া নিয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা ও সমালোচনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, মূলত বিভিন্ন সময় শিক্ষা বিভাগ থেকে অনেক কর্মকর্তারা কুয়াকাটায় আসেন, তাদের জন্য অনেক সময় রুম পাওয়া যায় না। তাই গেস্ট হাউজ হিসেবে কয়েকটি রুম করা হয়েছে। এগুলো কখনো সাধারণ মানুষের কাছে ভাড়া দেওয়া হয় না।
তার দাবি, বিদ্যালয়টির মোট চারটি কক্ষকে গেস্ট হাউজ বানানো হয়েছে। যার দুটি কক্ষের একটিতে গণিত শিক্ষক এবং একটিতে ইংরেজি শিক্ষক নিয়মিত থাকছেন এবং দুটি কক্ষ অতিথিরা এলে থাকেন।
বিদ্যালয়ের ক্লাস রুমকে গেস্ট হাউস বানানোর আইনগত ভিত্তি আছে কি না জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সাংবাদিকদের। এছাড়া অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ও কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল বারেক মোল্লা এবিষয়ে বলেন, স্কুলের ক্লাস রুমে গেস্ট হাউজ বানিয়ে ভাড়া দেওয়ার বিষয় তিনি কিছুই জানেন না । তিনি আরো বলেন, প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য থাকায় খলিলুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিষয়টি গতকাল জানতে পেরেছি। আজ সোমবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে বিবি গেস্ট হাউস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।