আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-আযহা, ২০২৫ উদ্যাপন উপলক্ষ্যে কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোরবানির পশুর অবাধ চলাচল / পরিবহন নিশ্চিতকল্পে সংবাদ সম্মেলন
বিলাল হুসাইন,চিফ রিপোর্টার:০৪ মে ২০২৫ খ্রি.
সকলের জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগে প্রাণিস্বাস্থ্য সেবা প্রদান, প্রাণির উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদাপূরণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
পবিত্র ঈদ-উল-আযহা সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবের অন্যতম উদ্দেশ্য পবাদিপশু কোরবানি। কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সারাদেশে পশুর চাহিদা নিরুপণ, সরবরাহ এবং কোরবানির পশুর অবাধ পরিবহণ নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। এছাড়া নিরোগ ও স্বাস্থ্যবান পশুর ক্রয়-বিক্রয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশু কোরবানী করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আজকের এ সংবাদ সম্মেলন।
আগামী কোরবানি ঈদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে আমাদের গবাদিপশুর বাজার স্থিতিশীল থাকে। পশু যাতে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তা নিয়ে খামারিদের সাথে কথা হয়েছে।
খামারিদের আশ্বস্ত করেছি, তারাও আমাদের আশ্বস্ত করেছে-এ বছর গবাদিপশু আমদানি করার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশীয় উৎপাদিত যে গবাদিপশু খামারিরা করেন, তা যথেষ্ট। প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা ঠিক আছে।
আগামী কোরবানির ঈদে বাজার যাতে কেউ অস্থিতিশীল করতে না পারে, সে জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই। আমরা আগামী কোরবানির ঈদ আনন্দের সাথে উদ্যাপন করতে পারবো; সেই প্রত্যাশা করছি।
চাঁদাবাজির কারণে পশুর দাম যেন না বাড়ে সেজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি, যেকোন সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মনে করছি।
১। এ বছর কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা
প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা নিরুপণ করেছে। এ বছরে কোরবানিযোগ্য হৃষ্টপুষ্টকৃত গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লক্ষ ২ হাজার ৯০৫ টি গরু-মহিষ, ৬৮ লক্ষ ৩৮ হাজার ৯২০ টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২ টি অন্যান্য প্রজাতিসহ সর্বমোট ১ কোটি ২৪ লক্ষ ৪৭ হাজার ৩৩৭ টি গবাদিপশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এবছর প্রায় ২০ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৩৫ টি গবাদিপশুর উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
২। স্টেরয়েড ও হরমোন ব্যবহার রোধে সচেতনতা সৃষ্টি ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা
সারাদেশে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গবাদি পশু হৃষ্টপুষ্টকরণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লালন-পালন বিষয়ে ৮৩ হাজার ৬৫৬ জন খামারিকে প্রশিক্ষণ, ৬ হাজার ৬০০টি উঠান বৈঠক, ২ লক্ষ ৭৪ হাজার ৩৭৮টি লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা হয়েছে।
স্টেরয়েড ও হরমোন ব্যবহার রোধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে খামারিদের প্রশিক্ষণ চলমান আছে এবং জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের যৌথ সহযোগিতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যে ৫৩ হাজার ২৬৩টি খামার পরিদর্শন করে খামারিদের স্টেরয়েড/ হরমোন এর কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
৩। কোরবানির পশু পরিবহনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ
বাসে বা পরিবহনে বাসের লকআপে ছাগল ও ভেড়া পরিবহন না করে সে বিষয়ে সচেতনতাসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হবে। প্রাণিকল্যাণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ পরিহার করতে হবে এবং যথাযথ পরিবহণের মাধ্যমে পরিবহণ নিশ্চিত করতে হবে। তা ব্যত্যয় হলে প্রাণিকল্যাণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কোরবানির পশুবাহী ট্রাক ছিনতাইরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে পশু পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (বিজিবি এবং বাংলাদেশ পুলিশ), জেলা প্রশাসন, জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের যৌথ সহযোগিতা গ্রহন করা হবে। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (হট লাইন-১৬৩৫৮) চালু থাকবে। যেকোন সমস্যা সমাধানে ফোন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মহাসড়কে বা যেখানে হাট বসালে যান চলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কিছু যাতে না হয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট জেলা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হবে। জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে উপজেলা ও জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সাথে একযোগে কাজ করবে। সড়কে বা সেতুতে কোরবানির পশুবাহী গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়াসহ যাতে রাস্তায় পশু আটকে কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি না করা হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৪। কোরবানির পশুর হাটে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম কর্তৃক চিকিৎসা প্রদান এবং মনিটরিং
সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিটি হাটে উপযুক্ত ও নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণপূর্বক ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের ক্যাম্প স্থাপন করাসহ দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় লজিষ্টিক সাপোর্ট থাকবে। ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের সেবা কর্মীদের জন্য এপ্রোন, মাস্ক, চেয়ার-টেবিল, বালতি, মগ ইত্যাদি সরবারাহ করা হবে।
গত বছরের মতো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ১৯টি পশুর হাটে পশুর প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য ২০টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের কার্যক্রম মনিটরিং এর জন্য ৫টি কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিম এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ২টি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় সমন্বয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, কন্ট্রোল রুম পরিচালনাসহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক টিম গঠন করা হবে।
সারাদেশে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম প্রাথমিক চিকিৎসা পরামর্শ, কোরবানির পশু নিরাপদ ও কোরবানি উপযোগী কিনা, কোরবানির পশু চেনার উপায়, সঠিক পদ্ধতিতে চামড়া ছাড়ানো ও বর্জ্য ব্যাবস্থাপনায় করণীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবে। তাছাড়া সারা দেশে বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম প্রয়োজনীয় চিকিৎস্যা সেবা প্রদানে নিয়োজিত থাকবে। এ বছর সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক (MVC) এর মাধ্যমে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর বিশেষ ভেটেরিনারি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হবে।
মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত মনিটরিং টিম ঢাকা শহরে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের কার্যক্রম মনিটরিং করবেন। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত মনিটরিং টিম সংশ্লিষ্ট উপজেলার ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের কার্যক্রম মনিটরিং করবেন। BTV ও BTV World এর পাশাপাশি সকল বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অনুমোদিত সতর্কীকরণ বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৫। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদিপশুর চামড়া ছাড়ানো বিষয়ক প্রশিক্ষণ
স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গবাদিপশু কোরবানির জন্য কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানো ও সংরক্ষণ বিষয়ে ১৫ হাজার ৩৬৯ জন পেশাদার ও ২১ হাজার ২০৮ জন অপেশাদার মাংস প্রক্রিয়াজাতকারী (কসাই) কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৬। অবৈধ উপায়ে গবাদিপশুর অনুপ্রবেশ রোধে কার্যক্রম গ্রহণ
আজকের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আন্তসীমান্তবর্তী জেলাসমূহে গবাদিপশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিজিবি, বাংলাদেশ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, জেলা প্রশাসন, জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সমন্বিতভাবে কাজ করবে। আজকের পর থেকে গবাদি পশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোরভাবে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
০৭। কোরবানীর পশু সরবরাহের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হবে। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ট্রেন ও নৌপথে পশু সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রাণি কল্যাণ আইন ২০১৯ মেনে চলতে হবে।
০৮। গবাদি পশুর হাটে পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশনের যৌথ সহযোগিতায় গবাদি পশুর হাটে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য অপসারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তাছাড়া যত্রতত্র স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে পশু কোরবানির বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হবে। প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপদ মাংস নিশ্চিতকরণে প্রাণি কল্যাণ আইন ২০১৯ প্রতিপালন করতে হবে।
গবাদি পশুর হাট ও পরিবহনের সময় পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।
পরিশেষে, আপনাদেরকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি।