খন্দকার সাইফুল নড়াইলঃ
নড়াইলের প্রধান ও গ্রামীন সড়কের মূর্তিমান আতংকের নাম ট্রলি, লাটা, লাম্বা, মাহিদ্র ও নসিমন নামের অবাধ বাহন। গত দুই বছরে এসব বাহনে দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছে অন্তত ২৫জন, আর আহত হয়েছে শতাধিক।
সর্বশেষ গত রবিবার (৫ মার্চ) সকালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ছােট কালিয়া মােড়ে একটি ইটভাটার ট্রলির ধাক্কায় বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ তবিবুর রহমান তােতা মিয়া (৭৫) নিহত হয়েছেন।
এছাড়া ১৯ জানুয়ারি কালিয়া-গােপালগঞ্জ সড়কের কালিনগর মােড় নামক স্থানে ইটবােঝাই ট্রলির ধাক্কায় রুবেল মােল্যা নামে এক প্রবাসী নিহত হন।১৫ জানুয়ারি দুপুরে নড়াইল-কালিয়া সড়কের আটলিয়া এলাকায় বালু বােঝাই ট্রলির চাকায় পিষ্ট হয়ে ইসমাইল শেখ (১২) নামে এক মাদরাসা ছাত্র নিহত হন।
১০ জানুয়ারি রাতে লােহাগড়ার লক্ষীপাশা-মহজন সড়কের খলিশাখালি মাটিবাহী ট্রলির ধাক্কায় ইলিয়াস শেখ (৪৭) নামে একজন নিহত হন।কালিয়া-চাপাইল সড়কের কালিনগর নামক স্থানে যাত্রীবাহি একটি ইজিবাইককে বালুবাহী ট্রলি চাপা দিলে ছােটকালিয়া গ্রামের মনিরুল মােল্যার স্ত্রী বন্যা বেগম (৩৭) নিহত হন।
এছাড়া কালিয়ার উথলি এলাকায় শ্যালাে ইঞ্জিনচালিত ট্রলি উল্টে সজিব শেখ (১৬), চাপাইল-তেরখাদা সড়কের পাখিমারা এলাকায় শামীম মােল্যা (৪৫), ইলিয়াস শেখ (৪৭), খড়রিয়া-নওয়াপাড়া সড়কে মাদরাসা ছাত্র অসিফ মিনা (১৭), নড়াইল-মাগুরা মহাসড়কে বাগডাঙ্গা গ্রামে ট্রলীর চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ যায় ৫ বছরের শিশু আব্দুল্লাহ’র। প্রাণ হারিয়েছেন বাঐসােনা গ্রামের বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ আইউব আলী মােল্যা (৭২)। এবং ২২ সালের ডিসেম্বরে নড়াইল-কালনা মহাসড়কের রামপুর এলাকায় নসিমন গাড়ি দুর্ঘটনায় পা হারান কাঠমিস্ত্রি লোহাগড়া উপজেলার জিকিরা গ্রামের আমানত শেখের ছেলে ইলিয়াস শেখ (২২)।
গত দুই বছরে এসব বাহনের দ্বারা সংগঠিত দূর্ঘনায় কমপক্ষে ২৫জনের প্রানহানী সহ শতাধিক লােক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।নড়াইলের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, অনুমােদনহীন এসব গাড়ীগুলাে মুলত নির্মাণ সামগ্রী, বালু, ইটভাটার মাটি সংগ্রহ, ইট সরবরাহ ও ভাটায় পােড়ানাের জন্য কাঠ সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
জমি চাষের ট্রাক্টর অথবা স্যালাে মেশিন দিয়ে দেশীয় মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করা এসব গাড়ীর নাই কােন সরকারি অনুমােদন। এর চালকদেরও নাই কােন লাইসেন্স। আবার বেশিরভাগ চালকই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তবু রাস্তায় বীর দর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা।
এসব নিয়ন্ত্রণের উল্ল্যেখযােগ্য কােন ব্যবস্থা নেই প্রশাসনের। ফলে একের পর এক ঘটছে দূর্ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দূর্ঘটনার পর স্থানীয়ভাবে মিমাংশা হয়ে যায় গাড়ীর মালিক ও ভুক্তােভােগীদের মধ্যে। ফলে থানায় কােন মামলা না হওয়ায় পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে নিতে পারে না কােন কার্যকরী পদক্ষেপ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৬০টি ইটভাটায় বিভিন্ন কাজের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০টি এ ধরনের অনুমােদনহীন বাহন চলাচল করে। ভাটার মালিকরা নিজেদের খরচ কমাতে ও সহজলভ্য হওয়ায় ব্যবহার করে এসব গাড়ী। তবে দূর্ঘটনায় প্রানহানী হলেও এ নিয়ে মাথাব্যাথা নাই কারাে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইটভাটার একজন ম্যানেজার বলেন, মূলত গ্রামের ছােট ছােট রাস্তায় ইট সরবরাহ করতে এসব গাড়ী ব্যবহার করা হয়। বড় গাড়ীতাে আর গ্রামের সব রাস্তায় ঢােকে না। তাছাড়া লােকাল মিস্ত্রি দিয়ে বানানাে এসব গাড়ীতে তুলনামূলক খরচও কম হয়।
মেসার্স Q N B ভাটার মালিক বিশ্বাস তায়েবুর রহমান বলেন,আমাদের নিজস্ব এধরনের কোন গাড়ি নেই, তবে ইট ও মাটি বহনে একটু সাশ্রয়ের জন্য ৯/১০টা ভাড়ার গাড়ি ব্যবহার করি।
মসার্স সুপার ব্রিকস্ এর ম্যানেজার রাজু আহমেদ ও একই শুরে আরো বলেন, আমার এসব গাড়ী কখনাে হাইওয়েতে চলে না। গ্রামের ভিতরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করে।
কালিয়ার বারইপাড়া বাসষ্ট্যান্ডের সামনে কথা হয় কলেজ ছাত্র ইমনরহমানের সাথে। তিনি বলেন, এসব গাড়ীর মধ্যে লাটা আর ট্রলিই সবচেয়ে মারাত্মক ও ভীতিকর। আর এসব গাড়ির চালকের মধ্যে শতকরা ৮০জনই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অল্পবয়সী এসব চালক গাড়ীতে উঠলে হুশ থাকে না। বেপরােয়া গতিতে চালানাের কারনেই দূর্ঘটনা ঘটে।
আরো কথা হয় নড়াইল সদরের শালিখা বাজারে বাঁশগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবলুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, আপনাদের মাধ্যমে নড়াইল জেলা প্রশাসক মহোদয় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন আমরা সাধারণ জনগণ নিরাপদে পথ চলতে চাই এবং অবৈধ গাড়ির হাত থেকে বাঁচতে চাই।
এ বিষয়ে একাধিক গাড়ী চালকের সাথে কথাবলে জানা যায়, এসব গাড়ী চালাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে বেশির ভাগ চালকই তা জানে না বা মনেই করে না। যারা জানে লাইসেন্স লাগে তারা অকপটে স্বীকার করলো লাইসেন্স নাই তাদেরও।
লাইসেন্স করেন না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সবারই ভাষ্য, গ্রামের ভিতর ছােট ছােট রাস্তা দিয়ে চলাচল করি। মেন রাস্তায় তাে বেশি একটা যাই না। তাছাড়া এসব গাড়ীর জন্য কােন ধরনের লাইসেন্স করা লাগে সে বিষয়ে আমাদের জানা নেই। ফলে ঝামেলায় যেতে চাই না।
তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি নড়াইল বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তারা।নড়াইল জেলা প্রশাসক মােহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, সকল ইটভাটায় এধরনের গাড়ী ব্যবহার করতে নিষেধ করবাে। তারপরেও যদি তারা এগুলাে চালায় তাহলে আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মােবাইল কাের্ট পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।