পটুয়াখালীতে জামাত নেতার মাদ্রাসায় নিয়োগ বাণিজ্য
নিজস্ব প্রতিবেদক:
পটুয়াখালীর মহিপুর থানা সদর ইউনিয়নের ইউসুফপুর দাখিল মাদ্রাসা সুপার জামাত নেতা মাওলানা হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে জেলা শিক্ষা অফিস। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে অনাস্থা প্রদান এবং ভারপ্রাপ্ত সুপারের অনিয়মের তদন্তে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করা হয়। ম্যানেজিং কমিটির ১১ সদস্যের আটজনের স্বাক্ষরিত ওই আবেদনের বিষয়ে সরেজমিনে ইতোমধ্যে দু’দফা তদন্ত হয়েছে। অনিয়মের মূলহোতা ওই মাদ্রাসার ভারপ্্রাপ্ত সুপার মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমানের কারণে শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে বলে দাবি শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের।
নাশকতা মামলার আসামী জামায়াত নেতা মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সুপার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নানা আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন।
সর্বশেষ তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজনকে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরী দেবার মিশনে মরিয়া হয়ে ওঠেন। মাদ্রাসাটি ২০২২ সালে এমপিওভূক্ত হবার মাত্র মাসকয়েক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ওই প্রতিষ্ঠানের সুপার মাওলানা মোঃ শফিকুল ইসলাম। এরপর আলাদিনের চেরাগ পেয়ে বসেন সহকারী সুপার মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান।
এ বিষয়ে ছাত্রী অভিভাবক হাফেজ আব্দুস সালাম ও আইয়ুব আলী জানান, মাওলানা শফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সুপারের দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার প্রায় ২২ বছর পরে মাওলানা শফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পরপরই মাদ্রাসাটি এমপিওভূক্ত হয়। এই দীর্ঘসময় মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ও মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্রের যাবতীয় কার্যাদি সুপার মাওলানা শফিকুল ইসলামই সম্পন্ন করে গেছেন। এদিকে এমপিওভূক্তিতে নয়ছয় করতে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত সুপারের অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)’র ওয়েবসাইটে থাকা মাদ্রাসাটির ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের শিক্ষক ডাটাবেজে ১৪ জন শিক্ষক কর্মচারীর তথ্য ছিল। স¤প্রতি আপলোড করা ২০২২ সালের প্যাটার্নে ১৭ জন শিক্ষক কর্মচারী দেখানো হয়েছে। মর্জিনা নামে একজন শিক্ষিকাকে বাদ দিয়ে মোঃ আল-আমিন (সহকারি শিক্ষক- কম্পিউটার) কে দেখানো হয়। একই সাথে আসমা (লাইব্রেরিয়ান), ইব্রাহিম (করণিক) ও মোঃ শিমুল খান (অফিস সহকারী) নামে আরও তিনজনকে যুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০০৫-২০১৮ এবং ২০১৯ সালে তাদের নিয়োগ দেখানো হলেও ব্যানবেইসের তথ্যভান্ডারে ২০২২ সালের আগে তাদের নাম নিশানা নেই। অভিযোগ রয়েছে, মাদ্রাসার সুপার মাওলানা শফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সুপার ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির যোগসাজসে সাবেক সুপার, তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা অফিসার এমনকি তৎকালীন মাদ্রাসার শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের স্বাক্ষর নকল করে ওই চারজনের নিয়োগ দেখানো হয়েছে। গত ১৩ জুলাই পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসার মুহা মুজিবুর রহমান সরেজমিনে তদন্তে এলে ম্যানেজিং কমিটির ৮ সদস্য এর বিস্তারিত তুলে ধরেন। তারা এসময় ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ ওমর ফারুক আকনের অন্তত সাড়ে তিন লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেন। এর আগে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শঙ্কর চন্দ্র বৈদ্য একই বিষয়ে তদন্ত করেছেন। ওই তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন জমিদাতা ও ম্যানেজিং কমিটির অধিকাং সদস্যরা।
মাদ্রাসার আয়া কহিনুর জানান, তাঁর চাকরির বয়সসীমা শেষ হতে বেশি দিন নেই জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত সুপার তার পরিবর্তে এমপিওতে আরেকজনের নাম পাঠানোর প্রস্তাব করে তাকে আড়াই লাখ টাকা ঘুষ প্রস্তাব করে। বিদ্যুৎসাহী সদস্য বদরুল আলম বলেন, ম্যানেজিং কমিটির মিটিং ছাড়াই সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সুপার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নিয়ে যা খুশি তাই করছেন। মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমানকে মহিপুর থানা জামায়াতে ইসলামী’র সাবেক আমির উল্লেখ করে আরও জানান, দেশদ্রোহ ও নাশকতাসহ অন্তত ছয়টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি মাদ্রাসায় অবৈধভাবে যাদের নিয়োগের চেষ্টা করছেন তারাও জামাত-শিবিরের ক্যাডার বলে দাবী করেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানাগেছে, করোনা মহামারীতে ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের এককালীন যে ভাতা দেওয়া হয়েছে সেখানেও সংযুক্ত ওই চারজনের নাম নেই। এদিকে সুপার নিয়োগ না দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা হাবিবুর রহমান পদ দখলে রেখেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। মাদ্রাসায় সুপার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মাহফুজা ইয়াসমিনসহ নিয়োগ কমিটির অন্যান্যরা উপস্থিত হন। কিন্তু সভাপতি মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে গা ঢাকা দিয়ে সুপার নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বানচাল করেন। এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ইউসুফপুর মহিলা মাদ্রাসা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ ওমর ফারুক আকন তার বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ অস্বীকার করে বলেন, ইউএনও আমাদের পক্ষে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন। মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান নিজেকে জামায়াতের একজন কর্মী দাবি করে বলেন, কোন আর্থিক অনিয়ম করিনি। সভাপতিকে অনাস্থা দেয়ার বিষয়টি কেবল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছি। পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসার মুহা মুজিবুর রহমান বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে তদন্ত করছি। সভাপতিকে অনাস্থার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভারপ্রাপ্ত সুপারের অভিযোগসমূহ খÐাতে যেসব কাগজপত্র দরকার তা তিনি এখনও দিতে পারেন নি। তবে শীঘ্রই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।