বিদেশমুখি প্রবণতা কমিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবাস্থার উন্নয়নে বদ্ধ পরিকর সরকার
সত্যকন্ঠ ডেক্স:
চিকিৎসকরা রোগীদের যথেষ্ঠ সময় না দেওয়া, হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়াসহ অন্তত ২১ কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনেকে আস্থা রাখতে পারছেন না। প্রতি বছরে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টসহ তিন থেকে চারটি রোগের চিকিৎসায় বেশি পরিমাণে বিদেশ যাচ্ছেন।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর সিরাডপ মিলনায়তনে দেশের প্রখ্যাত সকল চিকিৎসকদের নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এমনই মন্তব্য করা হয়।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ এসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) “চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখীতা: আমাদের উত্তরণের উপায়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারওয়ার বারী।
বিপিএমসিএ সভাপতি এম এ মুবিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অধ্যাপক ডা. মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. হুমায়ুন কবির তালুকদার বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথি জনস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারওয়ার বারী তার বক্তব্যে বলেন সরকার বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। আর তাই মেডিকেল এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালি করা হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে কমানোর জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবাস্থাকে আরও উন্নত করতে বদ্ধ পরিকর।
তিনি জানান, রোগীদের এই বিদেশ মুখাপেক্ষিতা রোধে অন্তর্বর্তী সরকার ক্যানসারসহ অন্তত তিনটি রোগের অত্যাধুনিক চিকিৎসায় কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের প্রস্তুত করছে। এছাড়াও এ খাতকে আরও ত্বরান্বিত করতে সরকার কর অব্যহতির জন্য ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ডের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। আর বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালার সংস্কারের কাজ ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছে সরকার।
বিপিএমসিএ সভাপতি এম এ মুবিন খান বলেন স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো এবং মান উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন জটিল রোগ নির্ণয় করার ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদির যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও চিকিৎসা খাতে গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং চিকিৎসকদের জন্য চলমান শিক্ষা প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়ানেরা পাশাপাশি চিকিৎসা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজন।
তিনি জানান, দেশের প্রধান শহরগুলিতে বিশ্বমানের বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করার দরকার।
প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে উচ্চমানের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
চিকিৎসা পর্যটনকে উৎসাহিত করার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অধ্যাপক ডা. মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাশ্রয়ী সেবার সঙ্গে চিকিৎসা পর্যটন খাতকেও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য সরকারকে কর ছাড়সহ আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এছাড়াও একটি জাতীয় বীমা স্কিম তৈরি করতে হবে যাতে জটিল সার্জারি ও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসহ সকল চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভবপর হয়। এতে মানুষ বিদেশে যাওয়ার চেয়ে দেশে চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠবে। অপরদিকে বিদেশে চিকিৎসা সেবা গ্রহণকে কম আকর্ষণীয় করতে কিছু নীতি বাস্তবায়ন করারও তাগিদ দেন তিনি।
বিপিএমসিএ সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, চিকিৎসা সেবায় কিছুটা উন্নতি হলেও অব্যবস্থাপনা ও মানসম্পন্ন চিকিৎসার ঘাটতি রয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের বাইরে পর্যটক ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশে চিকিৎসা বাবদ প্রকৃত ব্যয় আরো কয়েক গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়ন জরুরি। পাশাপাশি বিশ্বের নামকরা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে এই বিপুল অর্থ দেশে রাখা সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. মো. হুমায়ুন কবির তালুকদার বলেন পেশাজীবীদের মধ্যে ব্যবসায়ীরাই বেশি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভারতে যাওয়ার সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এরপর রয়েছে সিঙ্গাপুরের অবস্থান।
তিনি বলেন গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ রোগের চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে মানুষ। কারণ চিহ্নিত হয়েছে আটটি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের চিকিৎসা, যা মোট রোগীর ১৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম যাচ্ছে চোখ ও দাঁতের চিকিৎসা করাতে, যা মোট রোগীর ২ শতাংশ করে। এ ছাড়া ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী কিডনি রোগের, ১১ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী অর্থোপেডিক সার্জারির জন্য, ১১ শতাংশ করে রোগী লিভার ও ক্যানসার রোগের, ৯ শতাংশ রোগী নিউরোলজি, ৬ শতাংশ রোগী গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজি, ৫ শতাংশ রোগী নাক-কান-গলা এবং ৪ শতাংশ করে রোগী জেনারেল সার্জারি ও গাইনোকলজির চিকিৎসায় বিদেশে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যাণ্ডসহ ১৯টিরও বেশি দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন ৮ লাখেরও বেশি মানুষ, যার অধিকাংশের গন্তব্যই ভারতে।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যান্সার চিকিৎসা ও উন্নত সার্জারির মতো উচ্চমূল্যের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারকে আহ্বান জানান।