ভোটাররা সহজভাবে গ্রহণ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের সাগরিকাকে
সোহেল রানা, সত্যকন্ঠ; রাজশাহী:
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মানুষকে অনেকেই হিজড়া বলে থাকেন। সমাজে অবহেলিতদের তালিকতায় এই সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছে। পরিবার থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে চলতে হয় তাদের। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান তার সবই জোগান দিতে হয় নিজেদেরই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন তৃতীয় লিঙ্গের সুলতানা আহমেদ (সাগরিকা)।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া তৃতীয় লিঙ্গের সাগরিকার উঠে আসার গল্পটা অতোটা সহজ ছিল না। কারণ সচরাচর চলার পথে তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে দেখলে আঁতকে ওঠে মানুষ। কেউ ভয় পায়। কেউ বা আবার বিরক্ত হয়। অনেকে আবার তাদের সঙ্গে খারাপ আচারণও করেন। প্রতিনিয়ত এসবের সম্মুখীন হওয়া মানুষগুলোর সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত হওয়ার সংগ্রাম মোটেও সহজ নয়। সেই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃতীয় লিঙ্গের সাগরিকা।
সাগরিকার বাড়ি নগরীর শাহমখদুম থানার শিল্পীপাড়ায়। তবে তিনি থাকেন শিরোইল কলোনিতে। মা-বাবার চার সন্তানের একজন তিনি। বাবা নেই। বর্তমানে মা-বোন একসঙ্গে থাকেন। মাঝেমধ্যে তিনি বাড়িতে যান। তবে মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব সাগরিকার কাঁধেই। নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই অষ্টম শ্রেণি পাসের পরে থেমে যায় শিক্ষাজীবন। তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় থেমে যাওয়া শিক্ষাজীবন আর চালানো সম্ভব হয়নি। সাগরিকার বিভিন্ন প্রতিবন্ধতার বোঝা সমাজ পেরিয়ে পরিবার অবধি পৌঁছায়। এতে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে তাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাধা বিপত্তির মধ্যে কেটেছে তার জীবন। তবে এখন সব বাধা পেরিয়ে জনগণের সেবক হতে চান সাগরিকা। তাই নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে।
২০০০ সালে ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ নামের সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৫ সালে মহিলা অধিদপ্তর ও ২০০৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায় সংগঠনটি। তিনি হিজড়াদের ভোটাধিকার, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিয়ে কাজ করেছেন। ২০২২ সাল থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিপা প্রজ্ঞা বলেন, অনেকেই বলছেন সাগরিকার কথা। দেখা যাক নির্বাচনের তো এখন আর ক’দিন বাকি। সাগরিকা ছাড়াও এই ওয়ার্ডে আরও কয়েকজন প্রার্থী রয়েছে। তারাও বাড়িতে এসে ভোট চেয়ে যাচ্ছেন। চিন্তা ভাবনা করবো কাকে ভোট দেওয়া যায়।
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সুজন ইসলাম বলেন, অনেকেই তো ভোট দিয়েছি। ভোটের পরে আর কাউকে দেখা যায় না। এই সাগরিকাদের পরিবার পরিজন নেই। তাদের কোনো পিছুটান নেই। সাগরিকাদের মতো মানুষেরা সুযোগ পেলে সমাজের উন্নয়নে কাজ করবে।
সকালে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে সাগরিকা নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। বিকেলে ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনি প্রচার মিছিলে অংশ নেয়। এছাড়া এই ওয়ার্ডে সাগরিকাকে রুম থেকে পানি এনে খাওয়াতে দেখা গেল এক বৃদ্ধাকে। এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা সালেহা বলেন, ‘অনেকেই বলছেন সাগরিকা পাস করলে হিজড়াদের অত্যাচার বেড়ে যাবে। তবে আমার মনে হচ্ছে বাড়বে না, বরং কমবে। কারণ সাগরিকা কখনও চাইবে না তার ওয়ার্ডের মানুষ খারাপ থাকুক। একজন অবহেলিত সাগরিকা জনপ্রতিনিধি হলে এলাকার অবেহেলিত মানুষের পাশে সার্বক্ষণিক দাঁড়াবে বলে মনে করি।’
সাগরিকা বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ড। আমি শতভাগ আশাবাদী। মানুষ ব্যতিক্রম কিছু চাচ্ছে। এই ওয়ার্ডে আমি ছাড়াও ৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। সবার মধ্যে আমার জনপ্রিয়তা বেশি। সবাই আমাকেই চাচ্ছে জনপ্রতিনিধি হিসেবে। প্রতিটা বাড়িতে আমার ভোটার রয়েছে। আমি আনারস প্রতীক পেয়েছি। নির্বাচনের মাঠে নতুন হলেও ভোটাররা আমাকে চাচ্ছেন কাউন্সিলর হিসেবে। কারণ আমার কোনো পিছুটান নেই। আমি তিনটা ওয়ার্ড থেকে শতভাগ আশাবাদী। ভোটাররা আমাকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করবে। আমি আমার জনগোষ্ঠী ছাড়াও ওয়ার্ডের বাসিন্দারের অধিকার আদায়ে কাজ করবো।
সাগরিকা বলেন, তার নির্বাচনী ওয়ার্ডগুলোর মানুষের সঙ্গে আগে থেকে পরিচিত তিনি। নির্বাচনের মাঠ তিনি নিজের করে নিতে পেরেছেন। ভোটাররা পরিবর্তন চান, বিকল্প চান, তিনি সেই বিকল্পের প্রতীক। ভোটাররা আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করছেন। আমি নির্বাচনি ইশতিহার ঘোষণা করেছি। আমার নির্বাচনী তিন ওয়ার্ডে আলাদা কার্যালয় থাকবে। এছাড়া তিন ওয়ার্ডের জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হবে।
দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি মোহনা বলেন, সাগরিকা রাসিকের তিনটি ওয়ার্ডের প্রার্থী। তার জন্য আমরা সবাই কাজ করছি। তবে কিছু মানুষ বলে বেড়াচ্ছেন, সুলতানা পাস করলে হিজড়াদের অত্যাচার বেড়ে যাবে। এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আর এটা ভুল কথা। বেশিরভাগ মানুষই তাকে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন।