শুধু ইটভাটা থেকেই চাঁদাবাজি করেছে দেড়শ কোটি টাকা জামালপুরে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ দুষ্টচক্রের সর্বাধিনায়ক ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে!
মোঃ শামীম হোসেন, জামালপুর প্রতিনিধি:
দলীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অবৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে জামালপুর জেলার বিভিন্ন সেক্টরে বিগত সরকারের ধারাবাহিক শাসনামলে অনিয়ম, লুটপাটতন্ত্রের গড়ে উঠা দুষ্টচক্রের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বে সারা জেলা জুড়ে চলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, অবৈধ ইটভাটা, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা ধরনের দুর্নীতি। দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা ও সম্পদের পাহাড় করেছেন। শুধুমাত্র অবৈধ ইট ভাটা থেকেই চাঁদাবাজি করেছে অন্তত দেড়শ কোটি টাকা। বিগত ৫ আগস্টের পর লুটেরাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে গেলেও দুষ্টচক্রের সর্বাধিনায়ক ফারুক আহমেদ চৌধুরী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অভিযোগ উঠেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের প্রভাব খাটিয়ে জামালপুরে টেন্ডারবাজি, জমি দখল, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, অবৈধ ইটভাটা সমুহকে শেল্টার দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন ম্যানেজ করার নামে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, যমুনা সারকারখানা নিয়ন্ত্রনসহ সবই হয়েছে তাঁর একক নেতৃত্বে। নিজের কব্জায় নেন জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতি, জেলা ট্রাক-ট্যাংকলরী মালিক সমিতি, বেসরকারি ক্লিনিক মালিক সমিতি এবং জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি হন তিনি। এসব সমিতিগুলোর সভাপতির পদে থেকে বিভিন্ন পন্থায় তিনি শত শত কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন বলে দাবি করেছেন ওইসব সমিতি সংশ্লিষ্টরা। চাঁদাবাজি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে সম্প্রতি জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি ফারুক আহম্মেদ চৌধুরীকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়েছেন। অন্যসব সমিতিগুলোর পদে এখনো তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। জেলা ট্রাক-ট্যাংকলরী সেক্টরের ব্যাপক চাঁদাবাজি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় এই সেক্টরের শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। যে কোনো সময় ট্রাক ও ট্যাংকলরী মালিক সমিতির কমিটিও বিলুপ্ত হতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক শাসনকালে চাঁদাবাজির মহোৎসব এখনও বন্ধ হয়নি। ফারুক আহম্মেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে খুব সুকৌশলে এখনো সেটি চলমান। অন্তবর্তীকালীন এই সরকারের শাসনামলে চাঁদাবাজির সেই গতানুগতিক ধারার এখন পরিবর্তন চায় ভুক্তভোগীরা।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা শাসনামলে ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী জামালপুর জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও তিনি এই পদে বহাল আছেন। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার জোরে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রহীন অবৈধ ইট ভাটা চালু রাখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজের কথা বলে অবৈধ ইট ভাটা মালিকদের কাছ থেকে প্রতি বছর ৬ লাখ টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইট ভাটা মালিকরা জানান। তারা আরও জানান-ইটভাটার জ্বালানি হিসাবে কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহারের ব্যবস্থা ও আবাদী জমির টপ সয়েল ক্রয়ে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা এই সমিতি দেখবে বলে বৈধ ইট ভাটা মালিকদের কাছ থেকেও প্রতিবছর ৪ লাখ টাকা হারে চাঁদাবজি করেছেন। ইটভাটায় চাঁদাবাজির বিষয়টি ছিলো ওপেন সিক্রেট। আবাদী জমির টপ সয়েল বিনষ্ট এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করার কারণে পরিবেশের বিপর্যয় হবে জেনেও ফারুক চৌধুরী অবৈধ ইটভাটা মালিকদেরকে শেল্টার দিয়েছেন। অনৈতিক পন্থায় বিগত ১৭ বছরে ইট ভাটা মালিক সমিতির নামে ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী গং অন্তত দেড়শ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। চলতি মৌসুমেও সেই একই হারে মালিক সমিতি ইট ভাটা মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে জানায় কতিপয় ইট ভাটা মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটার এক মালিক জানান, চলতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে শুরু হবে মৌসুমের ইট পোড়ানো। তিনি আরও জানান, জেলায় ১২৩টি ইট ভাটা সচল আছে। মাত্র ১২টি ইট ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। অবৈধ ১১১টি ইট ভাটা মালিকরা প্রতিবছর ৬ লাখ টাকা হারে সমিতির ফান্ডে এই সতের বছরে মোট টাকা জমা দিয়েছেন ১১৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর ১২টি বৈধ ইট ভাটা মালিকরা ৪ লাখ টাকা হারে সমিতির ফান্ডে ১৭ বছরে জমা দিয়েছেন মোট ৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতিবছরই তারা আরও অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা করে প্রতিটি ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছেন বলে জানান। সেই হিসাবে ১২৩টি ইট ভাটা থেকে বিগত ১৭ বছরে আরও ৪১ কোটি ৮২ লাখ টাকা চাঁদা দিয়েছেন। এই সময়ে জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির নামে মোট ১৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হবার অভিযোগ উঠেছে। চাঁদাবাজির বিশাল অঙ্কের এই অর্থের সিংহভাগই ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী গং নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইট ভাটা মালিকদের অভিযোগ।
অভিযোগ রয়েছে, জেলার সাতটি উপজেলায় স্থাপিত ইট ভাটাগুলোর বেশিরভাগ ফসলি জমির মাঠে তৈরী করা হয়েছে। প্রতিটি ইট ভাটা মালিক পার্শ্ববর্তী ফসলি জমির টপ সয়েল সস্তায় ক্রয় করে ইট তৈরীর কাজে ব্যবহার করায় ফসলি জমির উর্বরতা হারাচ্ছে। এতে ফসলি জমির উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে প্রতিনিয়তই। ইট পোড়াতে কাঠ ব্যবহারের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন চলছে। সেই কাঠ ইট ভাটায় বিগত দিনে ব্যবহার হয়েছে এখনও হচ্ছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে উঠা অবৈধ ইট ভাটাগুলো পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফারুক আহম্মেদ চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
দ্রুত ফারুক আহম্মেদ চৌধুরীকে আইনের আওতায় আনার দাবি সচেতন জামালপুরবাসীর।