রাঙ্গামাটিতে কৃষকের নামে ঋণ জালিয়াতি
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি:
কৃষকেরা ব্যাংকে গিয়ে জানলেন তাঁদের নামে ঋণের কথা। জালিয়াতির হোতা কৃষি ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী নেতাসহ শক্তিশালী দালাল চক্র।
দিনমজুর রহমান লোকমুখে শুনেছেন, তাঁর নামে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির লংগদু কৃষি ব্যাংক শাখায় একটি কৃষিঋণ আছে। এরপর ব্যাংক থেকে নোটিশ আসার পর তিনি ওই ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ঘটনা সত্যি। বছর দুয়েক আগে ওই ব্যাংক থেকে তাঁর নামে চাষাবাদ বাবদ ৬০ হাজার টাকা শস্যঋণ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তিনি কোনো ঋণ নেননি, এমনকি ঋণের জন্য আবেদনও করেননি।
একই এলাকার শ্রমিক রফিকুলের নামেও ৪৫ হাজার টাকার ঋণ হয়েছে গত বছরের প্রায় একই সময়ে। ঋণের বিষয়টি রফিকুলেরও জানা নেই।শুধু রহমান ও রফিকুল নন, কৃষি ব্যাংকের এই শাখায় এমন অনেকের নামে ঋণ জালিয়াতির খোঁজ পাওয়া গেছে। গত মাসের শেষের দিকে অন্তত শতাধিক ব্যক্তি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, তাঁরা ঋণ জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। জানা গেছে, এই জালিয়াতি চক্রের অন্যতম হোতারা হলেন- আওয়ামী কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন, ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসেম ও আওয়ামী লীগ সদস্য শুক্কুর।
যেভাবে জালিয়াতি হয়েছে-এবিষয়ে উপজেলার আটারকছড়া ইউনিয়নের কৃষি ঋণ জালিয়াতির শিকার এমন কয়েকজন কৃষকদের সাথে যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের সাথে। তাদের সঙ্গে কথা হয় ১০ নভেম্বর। বলেন,আমাদের মধ্যে—অনেকেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত নই। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে ও দিনমজুরের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাই। একদিন লোকমুখে শুনে ব্যাংকে গিয়ে দেখি, আমাদের কারো কারো নামে নাকি ঋণ নিয়েছি।’
তারা জানান, গত বছর বোরো মৌসুমে ঋণ ওঠানোর জন্য এলাকার কেউ কেউ তাদের সাক্ষী করেন। কিন্তু এখন জানতে পারছেন, সাক্ষীর কথা বলে ঋণের কাগজে সই নেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের মাঠ সহকারী সহ কর্মকর্তারাও তাদের সহযোগিতা করেছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকটি ঘিরে ভয়ংকর একটি দালাল চক্র তৈরি হয়েছে। মাঠ সহকারী ও কর্মকর্তাদের মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় কবির, হাসেম, শুক্কুর, ফারুক, টিটু ও ছাত্তার সহ অনেকে কাজ করেন। এই চক্রের সঙ্গে ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। চক্রটি অভাবী মানুষদের শস্যঋণ করে দেওয়ার নামে জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাৎ করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকটির তথ্য বলছে, শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরে শস্যঋণ বাবদ অর্ধ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছিল। আমন ও বোরো মৌসুমে শতশত কৃষক এই ঋণসুবিধা পান। ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোটি-কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত শস্যঋণ বিতরণ চলমান রয়েছে। ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক বিটন চাকমা দাবি করেন, তিনি গত কয়েক মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। তখন থেকে স্বচ্ছতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম হয়নি।
এদিকে থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের ঋণ খেলাপির বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। কিন্তু কৃষি ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কোনো ভুক্তভোগী আইনের সহায়তা চাইলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঋণের টাকা ভাগাভাগি-কৃষকদের নামে শস্যঋণ নেয়ার পর দালাল চক্রের হোতারা নিরীহ কৃষাণীদের জনপ্রতি ২-৪ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। বছর পেরোলে নোটিশ আসলে জানতে পারেন, তাদের নামে ৪০, ৬০, ৬৫ হাজার টাকা করে ঋণ রয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করবেন বলে জানান জালিয়াতির শিকার কৃষকরা। রহমানের (ছদ্মনাম) ঘটনার পর একে একে প্রকাশ হতে শুরু করে ব্যাংটির ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। এক সপ্তাহে অন্তত ৩০ জন ঋণগ্রহীতা অভিযোগ করে বলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নামে ৬০-৮০ হাজার টাকা ঋণ হলেও তাঁরা কেউ কেউ হাতে পেয়েছেন ৫-৮ হাজার টাকা। আবার কেউ কেউ ঋণের বিষয়টি জানেনও না। ব্যাংকের নোটিশই তাদের কাছে প্রথম আলামত। তবে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা শতাধিক হবে বলে বলছেন স্থানীয়রা।এদিকে ঋণের শিকার আলীকে দালালেরা বলেছেন, ঋণের টাকা শোধ করা লাগবে না। সরকার থেকে আপনা–আপনি মাফ হবে। সে জন্য তিনিও গত বোরো মৌসুমের ঋণের আবেদন করেছেন। পেয়েছেন ৩০ হাজার টাকা। ঋণ–আতঙ্কে এলাকার মানুষ-
২০১২-১৩ সালে ব্যাংক কর্মকর্তা ও দালাল চক্রের যোগসাজশে প্রায় ৭ শতাধিক কৃষকের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩০ কোটি টাকার মতো আত্মসাৎ হওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল লংগদুতে। দেশ ব্যাপী এ ঘটনায় তীব্র অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন সচেতনরা। পরে এবিষয়ে মামলা হলে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। ওই ঋণ জালিয়াতিতে বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক সহ অসহায়রাও। কেউ কেউ ঋণের চাপে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে অভিযোগ ঋণগ্রস্তদের।সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো আবার। তবে এটা কৃষি ব্যাংকে। কিন্তু এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ বা আইনী ব্যবস্থা নিতে সংশয়ে আছেন দালালদের চাপে। তাই অনেক ভুক্তভোগী ঋণ জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন এবং আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক বলেন, বছর খানেক আগে কৃষি ঋণ করার জন্য ব্যাংকের লংগদু শাখায় যান। সেখানে দালাল চক্রের সদস্য ও ব্যাংকের লোক তাঁর কাছ থেকে ছবি ও আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়ে ঋণের আবেদনপত্রে সই করে নেন। কিন্তু তাঁকে ঋণ দেওয়া হয়নি। অথচ কাগজপত্র তৈরি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
তবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করা দালাল চক্রের মূল হোতাদের ব্যবহৃত ফোন নাম্বারে একাধিকবার কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
কৃষিঋণ পাওয়ার নিয়ম- বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কৃষিঋণ পেতে হলে আগ্রহী কৃষককে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ১০ টাকা দিয়ে হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খুলতে হবে। তিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর ব্যবস্থাপক তাঁর মাঠ সহকারী দিয়ে ওই ব্যক্তির জমি-জায়গা আছে কি না এবং কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, তা যাচাই করবেন। পরে ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা বিষয়টি যাচাই করবেন। প্রয়োজন হলে ব্যবস্থাপক নিজেও মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করতে পারেন।
সবশেষ ঋণগ্রহীতার ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জমির দলিল ও খাজনা প্রদানের দাখিলা যাচাই করে ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন ব্যবস্থাপক। এরপর ঋণগ্রহীতার হিসাব নম্বরে ঋণের টাকা চলে যাবে। এরপর ঋণগ্রহীতা চেকের মাধ্যমে তাঁর হিসাব থেকে টাকা তুলবেন। এর ব্যত্যয় হওয়া যাবে না। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, এখানে সব নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। নিয়ম মানা হলে ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটত না। এ ঘটনায় ব্যবস্থাপক দায় এড়াতে পারেন না।