ভাড়ায় চলছে লালপুরের সরকারি ডাকঘর
এ জেড সুজন মাহমুদ, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি:
নাটোরের লালপুর উপজেলা সদরের সরকারি ডাকঘর বেশি কয়েক যুগ যাবত ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে লালপুর ইউনিয়ন পরিষদকে। প্রতিদিন ডাকঘর থেকে সরকারের ভ্যাট আসে লক্ষ লক্ষ টাকা কিন্তু পোস্ট অফিসের এখনো পর্যন্ত কোনো বিল্ডিং বা জায়গা নির্ধারণ নাই। সেজন্য লালপুর ইউনিয়ন পরিষদকে প্রতি মাসে কারেন্ট বিল বাবদ ঘর ভাড়া সহ ৫০০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে চালাচ্ছেন লালপুর সদরের ডাকঘর।
সেখানে প্রতিনিয়ত কার্যক্রম চলার পরেও সেই প্রতিষ্ঠানের জমি বা বিল্ডিং বরাদ্দ নেই বলে জানিয়েছেন সহকারী পোস্টমাস্টার আব্দুল জাব্বার।তিনি বলেন, এক লক্ষ টাকা এফডিয়ে করলে প্রায় ১০ হাজার টাকা ভ্যাট কাটে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ টা এফডিয়ে হয় সেখান থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকার উপরে সরকারি ভ্যাট আসে কিন্তু আমাদের একটা বসার চেয়ার টেবিল এবং অফিস কক্ষ নাই। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি ব্রিটিশ আমল থেকে সেই থানা এবং পোস্ট অফিস দুইটাই লালপুরে হয়েছিল কিন্তু এখনো পর্যন্ত পোস্ট অফিসের কোন স্থায়ী অফিস কক্ষ নাই কোন জমি বরাদ্দ নাই, নাটোর জেলা হয়েছে বেশ কয়েক যুগ হলো কিন্তু মজার বিষয় যে আমরা ব্রিটিশের আমলের সিল স্বাক্ষর থেকে চালাই সেই সিলে রাজশাহী জেলা নাম দিয়ে এখনো পর্যন্ত চলে। কিন্তু কয়েক যুগ হয়ে গেল নাটোর জেলাকে ভাগ করা এখনো পর্যন্ত এই সিল এবং ডাকঘর অন্যান্য কোন কার্যক্রম পরিবর্তন হয়নি। লালপুরে বিভিন্ন ডাকঘর গুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
সেই সোনালী দিন আর নেই। ই-প্রযুক্তির ডানার ঝাপটায় বিপর্যয় নেমেছে ডাকঘরে। ছোট হয়ে আসছে ডাক বিভাগের পৃথিবী। এককালে মানুষের প্রাণভোমরা ডাক হরকরা স্মৃতির অলিন্দে ঠাঁই নিচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্য চিঠি। কালের বিবর্তনে ডাকঘরের গুরুত্ব অনেকটা হারিয়ে যাওয়ায় আজকাল সাইকেলের বেল বাজিয়ে ডাক পিয়নের ‘চিঠি এসেছে…চিঠি…’এমন কথাও আর শোনা যায় না।
আধুনিক যুগে চিঠি শূন্য এখন ডাকঘর। যার ফলে লোহার বাক্সে মরিচার আস্তরণ এতই জমেছে যে ঘুণে খাওয়ার মত ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। রংয়ের প্রলেপ উঠে যাওয়ায় তা এখন ছাল উঠা সারমেয় সদৃশ হয়ে পড়েছে।না পোস্টম্যান, না আমজনতা কেউই আর একে স্পর্শ পর্যন্ত করেনা এখন। ছোটবেলায় তারা শংকরের ডাকহরকরা পড়েছিলাম। রাতের ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ঝড়, বাদলা আর বিজলি উপেক্ষা করে মফস্বলের ডাকহরকরা ছুটে চলেছে লন্ঠন হাতে লাঠিকে সম্বল করে দূরের রেল স্টেশনে ডাক ধরাতে। পরে আরেকটু বড় হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে শুনেছি সুকান্তের রানারের ছুটে চলার কাহিনী। সব কিছুই স্বপ্নের মত স্নিগ্ধ আর আন্তরিকতায় ভরপুর মনে হত তখন। মোটকথা পোস্ট অফিসের প্রতি এক নষ্টালজিক অনুভূতি তখন থেকেই মগজে গেঁথে গিয়েছিলো। রবীঠাকুরের পোস্ট মাস্টার পড়ে জীবনে প্রথম ধাক্কা খেতে শিখেছি। সেই প্রথম জেনেছি,শহুরে শিক্ষিত বাবুদের অনেক ভাল কিছুর সাথে চতুরতা আর গা ঝাড়া দিয়ে শরীরের পানি সাফ সুতরো করার অনুষংগও থাকে। ছোট ছিলাম তাই বালিকা রতনের সাথে পোস্টমাস্টারের বিদায়ের শেষ ফয়সালা মেনে নিতে পারিনি।এ বিষয়ে উপজেলার ভেল্লাবাড়িয়া আব্দুল ওয়াহেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফতাব হোসেন বলেন,আমাদের কৈশোরে রুগ্ন,
উস্কোখুস্কো, আটপৌরে কাপড় পড়া সেই পোস্টম্যান ছিলো এক অপার বিস্ময়। ঝোলা হাতে বাড়ী বাড়ী চিঠি,মানি অর্ডার,পার্সেল ইত্যাদি পৌছে দেয়াই ছিলো তার কাজ।সলাজ বদনে সেই সামান্য আতিথেয়তাকে সম্মানও করতো।বাড়ীতে পোস্টম্যান এলে সাড়া পড়ে যেত।কখনো সেই চিঠিতে খুশীর বার্তা,কখনো বিষাদের খবর।চিঠি অথবা টাকা দিয়েই সে চলে যেত। গুরুজনদের দেখেছি খুশীর খবর পেয়ে বা প্রয়োজনের সময় হাতে টাকা পেয়ে খুব খুশি হতেন। কিন্তু বর্তমানে পরিবর্তনের স্রোতে সমাজ ছুটে চলেছে জনমানুষের রুচি,পছন্দ,অভ্যাস, চাহিদার যেমন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি দ্বিমুখী, ত্রিমুখী,বহুমুখীও হচ্ছে হরহামেশাই।যাযাবর দৃষ্টিপাতে বলেছেন,বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ,কেড়ে নিয়েছে আবেগ।সেই বেগের দ্রুতযানে চড়ে আমরা তেপান্তর পারি দিচ্ছি নিমিষেই।আবেগ প্রকাশে নিচ্ছি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্য। ইন্টারনেট,স্মার্ট ফোন শুধু খেলনা পাতির মত করায়ত্তই হয়নি এর কল্যাণে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার,ইন্সটাগ্রামসহ আরো আরো বাতায়ন আবেগ গ্রহণ ও প্রক্ষেপণের একান্ত আপনার মাধ্যম হিসেবে নিত্য সহচর হয়ে উঠেছে। এখন যোগাযোগ বলতেই এইসব।
এ বিষয়ে নাটর-১( লালপুর-বাগাতিপাড়া)
আসনে নৌকা মার্কার মনোনয়ন প্রত্যাশী লেঃ কর্ণেল রমজান আলী সরকার(অবঃ) বলেন, পোস্টাফিসের সেই হলুদ খাম,পোস্টকার্ড আর দেখা যায় না।নেই সেই লাল কালো পোস্টবক্স।নেই পোস্টম্যানের হাকডাক।এখন সময়টাই হলো একাকীর।কোথাও কোন হাকডাক নেই। পাশাপাশি অবস্থান হলেও যে যার মত দূরের বৃত্ত তৈরি করে উদ্বেগ, আবেগ, আলাপ,বিলাপ বিনিময়ে ব্যস্ত।আজকালের কিশোর, যুবারা এতেই সিদ্ধহস্ত,তুষ্ট। আবেগ,বিরহ, উল্লাস, আনন্দ, বেদনা, যাতনা, হর্ষ, বিষাদ প্রকাশে এর চেয়ে আর কোন বিকল্প মাধ্যম এখন অবধি আবিষ্কৃত হয়নি।বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসতি।সেই বাণিজ্য ঢেউয়ে পোস্টাফিসের আটপৌরে ভঙ্গুর দশা আজ অনেকটাই প্লাস্টার উঠা চুন সুড়কির অট্টালিকা সদৃশ। এই সুযোগে বেসরকারি বণিকালয় ‘ক্যুরিয়ার সার্ভিস’র নামে অসম প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়ায়।এর চমকে,ঠমকে পোস্টাফিসের তাবৎ ভগ্নদশা আরো প্রকট হয়ে উঠলো।ভেতরের লোকজনের উদাসীনতা, দায়িত্বে নিদারুণ অবহেলা আর প্রকারান্তরে বণিকালয়ের দক্ষিণা-আনুকূল্য পেয়ে এতকালের প্রাণের ডাকঘর তাসের ঘরের মত নিজেকে সমর্পণ করে বসলো।
ডাকঘরগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেয়া থাকলেও,আগের মতো মানুষজনের নেই কোনো আনাগোনা।কাজ তেমন না থাকায় শুধু অফিস বসে অলস সময় কাটাতে হয় কর্মচারী-কর্মকর্তাদের।
তিনি আরও বলেন,কালের বিবর্তনে পোস্ট অফিসের অনান্য কার্যক্রম হারিয়ে
গেলেও,রাষ্ট্রীয় কিছু চিঠিপত্র আদান-প্রদান করে তা এখনো টিকে আছে।এক সময় এই উপজেলার ডাকঘরগুলো মানুষের তথ্য আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।একাল সেকালের এরুপ চিত্র চিত্রণে রজনী শেষ হলেও তুল্যচিত্রের শেষ হবেনা।