ভোলায় নাসরিন লঞ্চ ট্রাজেডির ২০ বছর,
আজো আঁতকে ওঠেন স্বজনহারা মানুষেরা
সাব্বির আলম বাবু, বিশেষ প্রতিনিধিঃ
ভোলার ইতিহাসে ভয়াবহ একটি দিন ৮ জুলাই। নাসরিন লঞ্চ ডুবির বেদনায়ক ঘটনার ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০০৩ সালের এদিনে চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় রাত প্রায় ১১টার দিকে যাত্রী ও মালামালসহ নিমজ্জিত হয় লঞ্চটি। আর এর মধ্য দিয়েই ঘটে যায় বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি। যেখানে প্রায় ৮শ’ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। ওই দুর্ঘটনার পর থেকে এক এক করে পেরিয়ে গেছে ২০ বছর। সেই দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছে বাবা, কেউবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার কথা মনে করে আজো আঁতকে ওঠে স্বজনহারা মানুষেরা। আজো থামেনি তাদের কান্না। দিনটি ভোলাবাসীর জন্য এক শোকাবহ দিন। অনেক বৃদ্ধ পিতা-মাতা মেঘনার অথৈ পানিতে খুঁজে বের করতে পারেনি তার প্রিয় আদরের সন্তানের লাশটি। কেউ আবার পাননি প্রিয় স্বামীর লাশ। দুর্ঘটনার দুইদিন পর ভোলার মেঘনা নদী রূপান্তরিত হয়েছে লাশের নদীতে। দুর্ঘটনায় অনেকেই স্বপরিবারে মারা যান। কেউ বা পরিবারের এক বা একাধিক স্বজনকে হারান। অনেক মানুষের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিখোঁজরা ফিরে আসবেন এমন প্রতিক্ষায় এখনো অনেকে অপেক্ষায় আছেন। প্রিয়জন হারানোর পর পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু স্বজনহারা ক্ষত আজো কাঁদায় তাদের। ভয়ংকর দৃশ্য মনে পড়লে এখনো আঁৎকে উঠে ভোলার মানুষ। স্বামীহারা আফরোজা জানান, ছেলে-মেয়েদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছি, দুর্ঘটনার পর থেকে কেউ আমাদের খবর নেয়নি। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় সে ফিরে আসবে। তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি এখনো। যদি ভাগ্যে থাকে তো ফিরে আসবে সে। এমভি নাসরিন লঞ্চ দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ২৬ জনকে হারানোর স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন লালমোহন উপজেলার মোস্তফা। ওই দিন ওই লঞ্চে চড়ে ঢাকা থেকে বরযাত্রী বেশে আসছিলেন তারা।
জানা গেছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করার কারণে পানির প্রবল ঢেউয়ে নাসরিন-১-এর তলা ফেটে গেলে প্রায় ২ হাজারের বেশি যাত্রীসহ ডুবে যায়। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ধারণা করা হয়, লঞ্চ ডুবিতে কমপক্ষে ৮শ যাত্রীর সলিল সমাধি ঘটে।
এদের মধ্যে শুধু লালমোহনেরই যাত্রী ছিলেন ৪ শতাধিক। এছাড়া চরফ্যাশনসহ অন্য উপজেলারও কিছু যাত্রী ছিলেন। এরপর ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্বজনহারাদের কান্না আজও থামেনি। আজও সেই ভয়াল স্মৃতির কথা মনে করেন ভোলাবাসি। এ দিন এলেই তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দুর্ঘটনায় অনেকেই সপরিবারে মারা যান। অনেক নিখোঁজদের লাশ পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার এক-দেড় মাস পরও নিহতদের লাশ লালমোহন, চরফ্যাশন, মনপুরা ও দৌলতখান সংলগ্ন মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন পাড়ে ভেসে উঠতে থাকে। অর্ধগলিত ওই লাশগুলো শেষ পর্যন্ত শনাক্তও করতে পারেননি স্বজনরা। অনেক লাশ আবার বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।
বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের হিসাব অনুযায়ী নাসরিন দুর্ঘটনায় আট শতাধিক যাত্রী নিহত ও নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে চরফ্যাশনের ১৯৮ জন, লালমোহনের ২৬৪ জন এবং তজুমদ্দিনের ১৩ জনকে শনাক্ত করা গেছে। এদের মধ্যে ১১০ জন ছিল নারী। নিহত বা নিখোঁজ যাত্রীদের মধ্যে ছিল ৩৩ জন রিকশা/ভ্যান চালক, দুইজন ফেরিওয়ালা, তিনজন গার্মেন্টস শ্রমিক, ২৪ জন চাকরিজীবী, ৫৪ জন দিনমজুর, ৩৬ জন কৃষক, ১০ জন ড্রাইভার, ৩৬ জন ব্যবসায়ী, ৩৩ জন ছাত্র, ৬৬ জন গৃহিনী, ৯ জন গৃহপরিচারিকা, ৯৬ জন শিশু ও বৃদ্ধা। এই দুর্ঘটনায় ৪০২টি পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তি মারা যায়। এসব পরিবারের মধ্যে ১২৮টি পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ ব্যক্তি মারা যায়।
লালমোহন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন বলেন, লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। মর্মান্তিক সেই ‘দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা গেছে, তাদের মধ্যে লালমোহনের মানুষই বেশি। লঞ্চ মালিকপক্ষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিহত-নিখোঁজ পরিবারে সহায়তা করে সেই দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এ রুটে আরো ভালো মানের লঞ্চ চলাচলের পাশাপাশি নৌপথে মানুষকে আরো সতর্ক হয়ে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।