রাজা প্রমথভূষণ দেবরায় ছিলেন ঝিনাইদহ জেলের অন্তর্গত নলডাঙ্গা রাজবংশের শেষ স্ননামধন্য রাজা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু জনহিতৈষী প্রজাবৎসল রাজা।
তাঁর জনহিতকর কার্যাদির কথা ঝিনাইদহবাসি এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। জানা যায় জন্মসুত্রে তিনি নলডাঙ্গা রাজবংসের সন্তান ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাজা ইন্দুভুষণ দেবরায়ের দত্তক পুত্র ।
এ দত্তকপুত্র ছিলেন ঝিনাইদহ উপজেলার অন্তর্গত কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র।
রাজবংশীয় রক্ত নিয়ে জন্মগ্রহন না করলেও রাজকীয় গুনাবলি ও জনহিতকর কার্যাবলীর দরুন তিনি নলডাঙ্গা রাজবংশের শ্রেষ্ঠ “রাজা” হতে পেরেছিলেন।
নাবালক দত্তক পুত্র প্রমথভূষণ ১৮৭১ সালে নলডাঙ্গা জমিদারি পরিচালনার ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। সূক্ষ মেধা, একাগ্র মননশীলতা ও দক্ষতার সাথে জমিদারি পরিচালনা করে তিনি বিশেষ প্রশংসা লাভ করেন
রাজা ইন্দুভুষণের সময় রাজবাড়ি নলডাঙ্গা থেকে দক্ষিনে গুঞ্জানগরে স্থানান্তরিত করা হয়। প্রমথভূষণ দেবরায় গুঞ্জানগর রাজবাড়ির সংস্কার সাধন করেন। সুরম্য অট্টালিকা, সুগন্ধি ফুল-ফলের বাগান, চিড়িয়াখানা, পশু-পক্ষী সংগ্রহশালা, দেব-দেবীর মন্দির, নাটমন্দির নির্মানের ফলে রাজবাড়ির সমৃদ্ধি বহুলাংশে বুদ্ধি পায় এবং গুঞ্জানগর দর্শনীয় স্থানে পরিনত হয়। প্রমথভূষণ দেবরায় নলডাঙ্গা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রভূত উন্নতি করেন এবং জনহিতকর কার্যের মাধ্যমে যশস্বী হয়ে উঠেন। তাঁর সময় নলডাঙ্গা রাজস্টেটের বার্ষিক আয় ছিল তিন লক্ষ টাকার অধিক। ব্যায়ান্তে লাভ থাকতো প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। এর সিংহভাগ ব্যয় করতেন জনকল্যাণে। একারণেই তিনি হতে পেরেছিলেন একজন জনহিতৈষী প্রজারঞ্জক রাজা। মাগরা জেলার অন্তর্গত ন’হাটার নীলকুঠিসহ সমস্ত সম্পত্তি প্রমথভূষণ ক্রয় করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী ‘রাণী পতিত পাবনী’র নামে একটি স্কুল ও একটি দাতব্য চিকিৎসালয় সেখানে স্থাপন করেন। এই দু’টি প্রতিষ্ঠান এখনো সেখানে বিদ্যমান। পিতা ‘ইন্দুভূষণ’ ও মাতা ‘মধুমতি’ -এ নামে দু’টি বৃত্তি চালু করেন। রাজা ইন্দুভূষণ কর্তৃক ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মিডিল ইংলিশ স্কুলটি ১৯৪২ সালে ইংলিশ হাইস্কুলে পরিণত করা হয়। যশোরের ইংরেজ জেলা প্রশাসক মি. বেইটন -এর সুপারিশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০৯ সালে স্কুলটি স্থায়ী মঞ্জুরি পায়। ১৯৩৫ সালে স্কুলটি কালীগঞ্জে স্থানান্তরিত করা হয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে “নলডাঙ্গা ভুষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ” নামে পরিচিত। ইহা নলডাঙ্গা রাজাদের কীর্তি ঘোষণা করছে। ইহা ছাড়া তিনি নলডাঙ্গা ও কালীগঞ্জ এলাকায় অনেক রাস্তার উন্নয়ন, দিঘি ও জলাশয় খনন, চতুষ্পাঠী নির্মান ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজ করে যশস্বী হয়েছেন।
সুনাম ও দক্ষতার সাথে রাজকর্ম পরিচালনা ও জনহিতকর কার্যাবলীর স্বীকৃতি স্বরুপ তৎকালীন বাংলার ইংরেজ গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১৩ সালে প্রমথভূষণ দেবরায়কে ” রাজা বাহাদুর ” উপাধিতে ভূষিত করেন। যশোর ও খুলনার রাজা-জমিদারদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সনদপ্রাপ্ত “রাজা বাহাদুর ” ছিলেন । রাজা প্রমথভূষণ দেবরায় দক্ষতার সাথে ৪০ বছর জমিদারি পরিচালনা করেন। তিনি ১৯৪১ সালে ৮৫ বছর বয়সে কাশীতে মৃত্যুবরন করেন। তাঁর মৃত্যুতে ৩০ অধ:স্তন নলডাঙ্গার জমিদারির পরিসমাপ্তি ঘটে। বিষ্ণুদাসের তপবলে নলডাঙ্গা জমিদারি পত্তন হলেও সন্ন্যাসী ব্রাক্ষান্ডগিরির কৃপাবলে বংশের রাজ্যশ্রী ঘটে। আর রাজা প্রমথভূষণ দেবরায়ের দক্ষতাগুণে নলডাঙ্গা রাজবংশের সুনাম ও সুখ্যাতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।