পটুয়াখালী প্রতিনিধি:
ডিসেম্বর বাঙ্গালীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক স্মরনীয় মাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে গনহত্যা শুরু করে পাক বাহীনি। একসাথে শত শত মানুষের লাশ মাটি খুঁড়ে দেয় হয় গন কবর। এই কালো রাতের পরেই গর্জে ওঠে বাঙ্গালী। আর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানী হানাদার বাহীনির নির্মমতায় ঝড়ে যায় ৩০ লক্ষ তাজা প্রান। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসর্ম্পনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাঙ্গালীর স্বাধীনতা। শেষ হয় পাক হানাদার বাহিনীর শোষণ নিপিড়ন। জেগে ওঠে পৃথিবীর বুকে একখানা নতুন মানচিত্র।
যার নাম বাংলাদেশ। এদিকে সমগ্র বাংলা হানাদার মুক্ত হওয়ার আট দিন আগে ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী হানাদার মুক্ত হয়। তবে যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে সমগ্র দেশের মতো পটুয়াখালীতেও গনহত্যা চালায় পাক বাহিনী। কয়েকটি আলাদা স্থানে দেয়া হয় গন কবর। পটুয়াখালী পৌর এলাকার পুরাতন জেল খানা, যেটি বর্তমানে আনসার ব্যাটালিয়ন-৮ ক্যাম্প নামে পরিচিত। এই ক্যাম্পের মধ্যেও রয়েছে একটি গন কবর বা বদ্ধ ভূমি।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও বাংলার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কবরটি রয়ে গেছে অরক্ষিত অবস্থায়। কবরের আশেপাশের পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই সেখানে কখনো কোন কবর ছিল। প্রায় মাটির সাথে মিলিয়ে যেতে বসেছে কবরটি। বছরের মধ্যে মাত্র এক থেকে দুইটি বিশেষ দিনেই এই বদ্ধ ভূমিতে কিছু মানুষের আসা যাওয়া ব্যাতিত সারা বছর অবহেলায় পরে থাকে কবরটি। বীর শহীদদের কবরটি এমন ভাবে অরক্ষিত পরে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নির্মল কুমার রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা স্মৃতিচারন করে বলেন, যুদ্ধ চলাকালিন সময়ের এক পর্যায় পাক বাহীনি জেলার বিভিন্ন থানা থেকে তাদের সদস্যদের পটুয়াখালী সদরে নিয়ে আসে। এখানের সার্কিট হাউজে পাক বাহিনী জেলার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে।
এসময় তারা বিভিন্ন জায়গায় গনহত্যা চালায়। প্রথম গনহত্যা চালায় ইটবাড়িয়া ইউনিয়নে। সেখানে ২৪ জনকে হত্যা করে ও অনেক নারীকে ধরে নিয়ে এসে পাশবিক নির্যাতন চালায়। এর পরবর্তীতে লোহালিয়াতে গনহত্যা চালায়। বাউফলের ধুলিয়া ও কালিশুরি ইউনিয়নে গনহত্যা চালানো হয়। গলাচিপার চিকনিকান্দিতে গনহত্যা চালানো হয়।
পরবর্তীতে পটুয়াখালী জেল খানার অভ্যন্তরে শতাধীক লোককে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এবং সেখানে কয়েকটি কুপ খনন করে তাদেরকে মাটি চাপা দেয়া হয়। সেই বদ্ধ ভূমিটি আজও অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। এছাড়াও যে সকল জায়গায় গনহত্যা চালানো হয়েছিলো সেরকম অনেক জায়গা এখনো চিহ্নিত করা হয়নি।
যেটি আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলতে পারি যা বাংলাদেশের জন্য একটি নিন্দনীয় ব্যাপার। যেখানে সরকারের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে গনহত্যার স্থানগুলো চিহ্নিত হয়নি ও আমাদের জেল খানার মধ্যের বদ্ধ ভূমিটি অরক্ষিত রয়ে গেলো এটি প্রশাসন ও সরকারের কাছে আমার একটি প্রশ্ন।
এদিকে, আরো এক বীর মুক্তিযোদ্ধা অতুল চন্দ্র দাস বলেন, পটুয়াখালীর জেল খানায় যেটি বর্তমানে পুরাতন জেল খানা সেটির মধ্যে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার পুরুষ
নারীদেও ধরে এন হত্যা করে। এর পরে বড় বড় কবর খুঁড়ে দশ জন বিশ জন করে মাটি চাপা দেয়। মাটি চাপা দেয়ার পরে ওভাবেই রাখে। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্থানীয় প্রশাসন ও দেশের রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দর উপস্থিতিতে লাশ গুলো উত্তলন করা হয়। আমি দেখেছি সেই লাশের চিত্র। সেখানে মহিলাদের লাশ ছিলো, সাবেক পুলিশের লাশ ছিলো। আরো অনেক নামি দামি জানা অজানা বহু মানুষের লাশ ছিলো।
ওখানে প্রায় ১২০০ এর মতো লাশ ছিলো। পরে লাশ গুলোকে এক জায়গায় এনে জেল খানার এক কর্নারে পুনরায় দাফন করা হয়। এবং তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার দাবি ছিলো এখানে একটি সুন্দর স্মৃতিসৌধ হবে এবং স্মৃতিসৌধটি দৃশ্যমান হবেও এইটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। কিন্তু সেটা আজ পর্যন্ত হয়নি। স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও সেই জায়গাটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। খুবই কষ্ট হয়, খুবই দুঃখ হয়। যাদের জন্য আজ বাংলাদেশ তাদের মৃত্যুর পরের তাদের শেষ ঠিকানাটা নেই।
আমার দাবি যুদ্ধের সময় এখানে নর-নারী যারা মৃত্যুবরন করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন একটি স্মৃতিসৌধ করা হোক। আমি পৌরসভা জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করছি তারা যেনো রাজনৈতিক ব্যাক্তিদেরকে সাথে নিয়ে একটি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলেন। সেখানে যেনো আমরা যেতে পারি। আগামী প্রজন্ম যেনো দেখতে পারে স্বাধীনতার জন্য এদেশের যারা জীবন দিয়েছে তাদেও স্মৃতিস্তম্ভ।
এবিষয়ে পটুয়াখালী পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, আমাদের যে বদ্ধভূমিটা সেটা একটি জেল খানার মধ্যে অবস্থিত। আমরা অনেক বছর পরে হলেও সিদ্ধান্ত নিলাম মানুষের সহজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে।
জেলখানার একটি দেয়াল অপসারন করে বদ্ধভূমিটিকে মনুমেন্ট করে এটিকে যাতে মানুষ দেখতে এই জায়গাটি যাতে সবার নজরে আসে আমরা সেই ব্যাবস্থা করছি। এতে আমাদের নুতন প্রজন্ম জানতে পারবে এখানে কি হয়েছিল। জানতে পারবে স্বধীনতার যুদ্ধের সময় পটুয়াখালীবাসির কি ভূমিকা ছিলো।