মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার
মাটি মামুন রংপুর।
মাটির সাথে আত্মার সম্পর্ক এখানকার প্রতিটি মানুষের।কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দিন দিন ব্যবহার কমতে শুরু করেছে।প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মাটির তৈরি জিনিসের বিকল্প হিসেবে বাজার দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও সিরামিক।তবুও রংপুরে মৃৎশিল্পের দাপট ও কদর অনেক।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দেড় হাজারের অধিক পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছে বৈশাখ ঘিরে বেড়েছে ব্যস্ততা।বলছি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ডাবরা পালপাড়া গ্রামের কথা।এই মিঠাপুকুর উপজেলার
ডাবরা পালপাড়া গ্রামের কুমারপল্লীতে ঢুকলেই দেখা মেলে সে চিত্র।উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির তৈরি এসব জিনিসপত্র সরবরাহ করেন তারা।
বর্তমানে এ জেলায় পাঁচ শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তবুও তাদের অতি কষ্টের জীবনযাত্রা।
গোটা পল্লীতেই লেগে আছে যেন হাজারো কষ্ট আর অভাবের ছাপ।সরেজমিনে দেখা যায়, বৈশাখ ঘিরে ব্যস্ততা বেড়েছে মৃৎশিল্পীদের।তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র।প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের
ভিড়ে এখনও মৃৎশিল্পকেই পেশা হিসেবে টিকিয়ে রেখেছেন এখানকার পাঁচ শতাধিক পরিবার।গবেষকদের মতে, বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।ডাবরা পালপাড়া কুমার পল্লীর শ্রী মঞ্জুনাথ পাল এর সাথে কথা
বললে তিনি এই প্রতিবেদক জানান, বাজারে এখন মাটির তৈরি পণ্যের কোনো কদর নেই।
প্লাস্টিক পণ্যের উপর মানুষের চাহিদা অনেক বেশি। মাটির জিনিসপত্রের প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন এই মৃৎশিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে।
জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। আজকাল কুমারপাড়ার মেয়েদের ব্যস্ততা অনেক কমে গেছে। হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী মাটির তৈরি সামগ্রীর চাহিদা কমতে থাকায়, প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।
মানুষ যখন কোনো কিছু সুন্দর করে আঁকে, সুন্দর করে তৈরি করে, সুন্দর সুর করে গেয়ে থাকে, তখন তাকে শিল্প বলা হয়। শিল্পের এ কাজকে বলা হয় শিল্পকলা। আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প। মাটির তৈরি শিল্পকর্মকে বলা হয় মাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি।
তবে সব মাটি দিয়ে এই কাজ হয় না। দো-আঁশ মাটি তেমন আঠালো নয়, আর বেলে মাটি ঝরঝরে, তাই এগুলো দিয়ে মাটির শিল্প হয় না।মৃৎশিল্পের জন্য দরকার পরিষ্কার এঁটেল মাটি। এঁটেল মাটি বেশ আঠালো। আবার এঁটেল মাটি হলেই যে তা দিয়ে শিল্পের কাজ করা যাবে তাও নয়।
এ জন্য দরকার যত্ন আর শ্রম। দরকার হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান।পাশাপাশি প্রয়োজন কিছু ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম।এসব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম হলো একটি কাঠের চাকা। এই চাকায় নরম মাটির তাল লাগিয়ে বিভিন্ন
আকারের মাটির পাত্র ও বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে কুমোররা। মৃৎশিল্পের মূল কারিগর আমাদের দেশের কুমোর সম্প্রদায়। যুগ যুগ ধরে কুমোররা বংশ পরম্পরায় তৈরি করে আসছে বিভিন্নরকম মৃৎশিল্প। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে রয়েছে- মাটির কলস, হাঁড়ি,
সরা, বাসন-কোসন, পেয়ালা, সরাই, মটকা, জালা, পিঠে তৈরির বিভিন্ন ছাঁচ ইত্যাদি। এ ছাড়া কুমোরেরা তৈরি করে আসছে উৎসব-পার্বণের জন্য বিভিন্ন রঙের বাহারি মাটির জিনিস, তৈজসপত্র। হাঁড়ি-কলসি ছাড়াও আমাদের বাংলাদেশে এক সময় গড়ে উঠেছিল সুন্দর পোড়ামাটির ফলকের কাজ।
এর অন্য নাম টেরাকোটা।এ টেরাকোটা বাংলার অনেক পুরোনো শিল্প। নকশা করা মাটির ফলক ইটের মতো পুড়িয়ে তৈরি করা হতো এ টেরাকোটা। শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, বৌদ্ধস্তূপ ও দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে এই টেরাকোটার কাজ রয়েছে। তা ছাড়া
বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে পাওয়া গেছে পোড়ামাটির অপূর্ব সুন্দর কাজ। পোড়ামাটির এই ফলক বাংলার প্রাচীন মৃৎশিল্প।সম্প্রতি নরসিংদীর ওয়ারীবটেশ্বরে পাওয়া গেছে প্রায় হাজার বছর আগের সভ্যতার নিদর্শন। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের সুন্দর মাটির পাত্র আর ফলক।
রংপুর বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মোশাররফ হোসেনের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছি। ব্যাপকভিত্তিতে মাটির তৈরি জিনিস রপ্তানি করা গেলে আরো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেত।বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী
শিল্পগুলোর অন্যতম হচ্ছে মৃৎশিল্প। এটি শুধু শিল্প নয়, আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।এদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উমর ফারুক বলেন, মাটির নান্দনিক কারুকার্য ও বাহারি নকশার কারণে এ শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে, যাতে বাইরের রাষ্ট্রে রপ্তানি করা যায়, তার জন্য আরো বেশি করে উদ্যোগ নিতে হবে। দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগ।
মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমার এবং পালদের সহজ শর্তে ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্নমুখী উৎপাদন বাড়াতে হবে।এ দেশীয় শিল্পের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।