প্রণোদনা দিয়েও ভোলায় আউশের আবাদে ফলন কম হওয়ায় হতাশ কৃষক
সাব্বির আলম বাবু, বিশেষ প্রতিনিধিঃ
নানা কারণে এবার ভোলায় আউশের ফলন ভালো হয়নি। এতে প্রণোদনা দিয়েও কৃষকদের এই ধান আবাদে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। আবহাওয়া ও জমির গুণগত মান অনুযায়ী ভোলা আউশ চাষের জন্য একটি আদর্শ জেলা। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চলতি বছর সর্বোচ্চ প্রণোদনা দিয়েও আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।
ফলনও আশানুরূপ হয়নি। অনাবৃষ্টি, সেচ ও মিষ্টি পানির সংকট, দাবদাহে বীজতলা নষ্টের কারণে আবাদ কম এবং ধান বের হওয়ার সময় অতিবৃষ্টির কারণে ফলন ভালো হয়নি বলে জানিয়েছেন কৃষক ও কৃষিবিদেরা। এসব কারণে কৃষকেরা আউশ ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় প্রতি হেক্টরে ধানের গড় ফলন হয়েছে সাড়ে চার মেট্রিক টন। হেক্টরে চাল হয়েছে ২ দশমিক ৮৩ মেট্রিক টন। সেচ-সুবিধা, পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলে আবাদি জমি বাড়ানোর পাশাপাশি বাম্পার ফলন হতে পারে বলে কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
এই জেলার প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমিতে (৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ একর) আউশ ধান আবাদ করা সম্ভব। ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছর ৮৮ হাজার ৩৩৫ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৬৮ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমিতে।
জমিতে ধানের ফলন হয়েছে ৩ লাখ ৯ হাজার ২৩১ মেট্রিক টন (যা চালের হিসাবে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৫ হাজার ১১৪ মেট্রিক টন)। আউশ ধান উৎপাদন করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ভোলার ২৯ হাজার কৃষককে ২৯ হাজার বিঘায় আউশ আবাদ করার জন্য ৫ কেজি বীজ ধান, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি করে এমওপি সার প্রণোদনা হিসেবে দিয়েছে। তারপরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে সরকার আউশ আবাদে প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে। সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভোলার ৭ হাজার ২০০ কৃষককে এ প্রণোদনা দেয়। তার আগে আরও কম কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে সেই প্রণোদনা ২৯ হাজারে উন্নীত হয়েছে। গত ১০ অর্থবছরে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা খুব কমই পূরণ হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে জেলার ৭৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৪৪৮ হেক্টরে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮৩ হাজার ১৯৫ হেক্টরে এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ করা হয়। তার পরের বছর থেকে আবার তা কমতে থাকে।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার নানা কারণ
সরেজমিনে কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোলায় রয়েছে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এসব বাঁধ ভোলার পূর্বের মেঘনা নদী, পশ্চিমের তেঁতুলিয়া নদী, উত্তরের ইলিশা নদী এবং দক্ষিণের সাগর মোহনার তীরে। বাঁধ দেওয়ার ফলে ভোলার মূল ভূখণ্ডের সব জমি তিন ও চার ফসলি হয়েছে।
রবি মৌসুমে ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর এবং আমন (খরিপ-২) মৌসুমে ১ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে নানা রকম ফসলের আবাদ করা হয়। আউশ (খরিপ-১) মৌসুমে প্রায় ১৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ করা সম্ভব। জানা যায়, ভোলার মেঘনা নদীর পানি লবণাক্ত। যদিও বর্ষার সময় পানির লবণাক্ততা থাকে না। তেঁতুলিয়া ও ইলিশা নদীর পানি মিষ্টি।
ভোলার বেশির ভাগ খাল তেঁতুলিয়া নদী থেকে উঠে কোনো না কোনোভাবে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। জোয়ারের সময় যাতে মেঘনা নদী দিয়ে লবণপানি না উঠতে না পারে, এ কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে মেঘনা নদীর তীরে খালগুলোর মুখে ২৪টি জলকপাট (স্লুইসগেট) দিয়েছে।
এসব জলকপাট নিয়মিত সংস্কার না করার কারণে বেশির ভাগই বিকল হয়ে আছে। সঠিকভাবে কাজ করছে না। বন্ধ জলকপাট দিয়ে লবণপানি ঢুকে পড়ে। লবণপানি থেকে বাঁচতে অনেক বিকল জলকপাটের মুখে মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ভাঙনের কারণেও বাঁধ পড়েছে খালের মুখে। বাঁধ ও বর্জ্য ফেলার কারণে এসব খাল শুকিয়ে যায়। খালের মধ্যে ফেলা বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে না। যথাযথ খননও হচ্ছে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলার খালগুলোর ওপর যত্রতত্র অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্ট হচ্ছে। যেখানে সেতু-কালভার্ট হচ্ছে, সেখানে উঁচু বাঁধের মতো মাটি, ইট-পাথরের স্তূপ থাকায় খাল নাব্যতা হারাচ্ছে। বেশির ভাগ সময় এসব সেতু-কালভার্ট নির্মাণের সময় খালের মধ্যে বাঁধ দেওয়া হয়, কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হলেও ওই বাঁধ কাটা হয় না।
কাটলেও ভালোভাবে কাটা হয় না। খালের মধ্যে পিলার তুলে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। খালের মুখে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। উন্মুক্ত জলাশয়ের দুই পাশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) মো. হাসান ওয়ারিসুল কবির দাবি করেন, আউশ সাধারণত হেক্টরে চার-পাঁচ টনের বেশি হয় না। এ বছর বৃষ্টি ছিল না বললেই চলে। সেখানে সাড়ে চার মেট্রিক টন হারে হয়েছে।